করোনাভাইরাস: রোগী, চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবীর প্রতি সবার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কেন?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী, চিকিৎসক এবং স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতি মানুষের আচরণ এক ভিন্ন সংকট তৈরি করেছে বাংলাদেশে। আক্রান্ত অনেক রোগী ও তাদের পরিবারকে সামাজিকভাবে একঘরে হতে দেখা যাচ্ছে আবার রোগীর সেবার নিয়োজিত অনেক স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক এবং স্বেচ্ছাসেবীদের সমাজে অমানবিক আচরণেরও শিকার হতে দেখা যাচ্ছে।
সারা পৃথিবীতে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রশংসিত হচ্ছেন বাহবা পাচ্ছেন কিন্তু তার অনেকটা উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এখানে করোনাভাইরাস নিয়ে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা সমাজে তারা স্বাদরে গৃহীত হচ্ছেন না।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দু’জন চিকিৎসক তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এরমধ্যে একজন চিকিৎসক সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন যিনি এখন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ওই চিকিৎসক জানান, তিনি নিজে যেমন হতাশ তেমনি তার সঙ্গে কাজ করা সেবিকাদের কেউ কেউ বাড়ীওয়ালাদের কাছ থেকে অমানবিক আচরণের শিকার হয়েছেন।
‘কিছু সিস্টারদের তাদেরকে বাড়িওয়ালার বলেছেন যে আপনি তো ওই হাসপাতালে কাজ করেন আপনি বাসায় আসবেন না। এধরনের একটা মনোভাব তারা দেখায়।’
নিজের অভিজ্ঞতাও খুব একটা সুখকর নয় উল্লেখ করেন এ চিকিৎসক জানান তাদেরকে যেখানে কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে সেখানে রাখতেও রাজী হচ্ছিলেন না সরকারি লোকজনই।
‘দেখা যাচ্ছে আমাদেরকে নিয়ে একটা স্টিগমা তারা মনের মধ্যে রেখে দিছেন। যেন আমরাও আক্রান্ত। বাড়ি থেকে খাবার এনে দিলে গেট পর্যন্ত গিয়ে আনতে গেলেও শোনা যাচ্ছে আনসারদের বলা হয়েছে ওনারা যেন গেইট পর্যন্ত না আসে।’
বাস্তবে তাদের কেউ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত না হলেও প্রতিনিয়ত এমন নানা মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে। করোনাভাইরাস নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা যথাযথ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছেন। বাড়তি সতর্কতার জন্য আলাদা থাকছেন। তবে বিদেশে যারা করোনা রোগীদের সেবায় কাজ করছেন তাদের প্রতি ৫ দিন পর পর টেস্ট করা হয়।
বাংলাদেশে যেহেতু কিটের স্বল্পতা তাই এই ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই বলা যায় যারা কাজ করছেন, সেবার মানসিকতা নিয়েই কাজ করছেন। কিন্তু বিদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের এই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা নিয়ে ব্যাপক প্রশংসা করা হয়। নিজ দেশে সেটা না পেয়ে হতাশ হয়ে যাচ্ছেন তারা।
‘আমরা যে মানসিকতা নিয়ে কাজটা করতেছি আমাদেরকে যদি এই মোটিভেশনটা দেয়া না হয় তাহলে দেখা যাবে আমরা কাজ করাই ছেড়ে দিব। আমার মনের মধ্যে একটা ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে যে না, মানুষজন তো আমার ফিলিংসটা বুঝতেছে না।’
অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে এ চিকিৎসক বলেন,‘আমি আজকে ঘরের থেকে বাইরে ২১দিন হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার ঘর ছেড়ে ফ্যামিলি মেম্বার ছেড়ে বাইরে আছি, সেক্ষেত্রে এই ধরনের পরিবেশ যদি তৈরি হয় তাহলে অবশ্যই আমরা মানসিকভাবে বিষণ্ণ হই, হতাশ হই, আমরা কাজ করার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলি।’
হাসপাতালে কাজ করে এলাকায় আসা যাওয়ায় বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলে জানান একজন নারী চিকিৎসক। তার হাসপাতালে করোনা আইসোলেশন ইউনিট থাকার কারণে এলাকার লোকজন অনেকে তাকে ভাইরাস বাহক হিসেবে মনে করছে দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তন দরকার।
‘আমাদের এলাকায় যদি করোনা আসে তাহলে এর (ডাক্তার) মাধ্যমেই আসবে, এমন কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। কেন এরকম বলবে? তারাওতো একসময় আমার কাছে আসতে পারে অসুস্থ হয়ে।’
এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেই রোগী বা তার পরিবারের প্রতিও অমানবিক আচরণ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র জানান তার বাবা মা দুজনই আক্রান্ত কিন্তু এ খবর জানার পর থেকে এলাকাবাসীর যে আচরণ তিনি পেয়েছেন সেটা কল্পনাও করতে পারেননি।
ওই ছাত্র জানান, তাদের প্রতি এলাকার মানুষের একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে।
‘ইভেন রুমের জানালাগুলো আমাদের আটকে রাখতে হচ্ছে। কেউ কেউ বলছিল আমাদের চারজনকেই চলে যাওয়া উচিত বাসা থেকে, ওনারা তালা মেরে দিবে এরকম কিছু কথা শুনছিলাম আরকি,’ তিনি বলেন।
‘তখন খুব খারাপ লাগছিল কারণ ওনাদের সঙ্গে আমাদের এত ভাল সম্পর্ক, কখনো কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয় নাই আর ওই মানুষগুলোই এই টাইপের কথা বলতেছে সামান্য করোনাভাইরাসের কারণে। আমার এত খারাপ লাগছে ওইরাতে আমি ঘুমাতেই পারি নাই।’
স্বাস্থ্যসেবা দিতে যাওয়া ঠেকাতে ‘রাস্তায় ব্যারিকেড’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃদু সংক্রমণ হয় যারা বাড়িতেই চিকিৎসা নিতে পারেন। এই ভুক্তভোগীর বাবার মৃদু সংক্রমণ থাকলেও এলাকাবাসীর চাপে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দিতে পারেননি। মফস্বল এলাকায় রোগীর নমুনা সংগ্রহে স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন আসমা রিতু। এ কারণে এলাকায় ঢুকতে বের হতে বাধার মুখে পড়েছেন ওই স্বেচ্ছাসেবী। রিতু জানান এজন্য তাকে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিতে হয়েছে।
‘প্রত্যেকদিন ১৫ কিলোমিটার যাওয়া ১৫ কিলোমিটার আসা। ত্রিশ কিলোমিটার শুধু আমি আপ-ডাউন করি শুধু স্বেচ্ছাসেবী কাজ করার জন্য। তারপরে আমার এলাকার লোকজন আশেপাশের লোকজন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দেয়, যাতে আমি এলাকা থেকে বাহির না হয়ে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে না পারি!’
লাশ দাফন করায় গ্রামে ফিরতে বাধা
এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। শুরুর দিকে ঢাকায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের লাশ দাফন করা যাবে না কবরস্থানে এমন ব্যানার দেখা গিয়েছিল। এখন করোনা আক্রান্ত হয়ে কিংবা আক্রান্ত সন্দেহে কেউ মারা গেলেও লাশ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে পুলিশকে।
গত সপ্তাহে ঝিনাইদহ সদরে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে মৃত এক ব্যক্তির জানাযা পড়িয়েছেন স্থানীয় ইউএনও। তাৎক্ষণিকভাবে হুজুরকে না পেয়ে এই জানাযা সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু কোনও হুজুরকে ডেকে পাওয়া যায়নি বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু ওই ব্যক্তির দাফনের সময় ভাই ছাড়া পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এছাড়া দাফনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বেচ্ছাসেবকরা এলাকায় ঢুকতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছিলেন।
ঝিনাইদহ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার এ দাফন প্রক্রিয়ার তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন এ ধরনের বিষয়গুলো তাদেরকে খুব পীড়া দিচ্ছে।
‘আঞ্জুমান মফিদুলের যে সমস্ত সদস্যরা এই কবর খোঁড়ার কাজে এবং লাশ দাফনের কাজে সহযোগিতা করেছিল তাদেরকে তাদের গ্রামবাসী গ্রামে ফিরতে দিচ্ছিল না। তাদের মাধ্যমে গ্রামে করোনাভাইরাস ছড়াবে এমন ধারণা গ্রামবাসীর মধ্যে। অথচ তারাই বিনা কারণে বাজারে ঘোরাফেরা করছে সে বিষয়ে তাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি মনে করি আমাদের যে মানবিক মূল্যবোধ এটি তার অবক্ষয়,’ বলেন তিনি।
কেন এমন আচরণ?
দুর্যোগকালে ভীতি থেকে এ ধরনের আচরণ বা প্রতিক্রিয়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলেও জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার। এই সময়টা চলে গেলে তাদের নিজেদের এসব আচরণ নিয়ে মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্যের প্রচার জরুরি এবং প্রয়োজনে শিক্ষিত ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
‘এটা সমাজের একটা বিশেষ অংশ করছে। তারাই এটা করছে যাদের মধ্যে এক ধরনের অজ্ঞতা রয়েছে, যারা অনেক বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যারা যা শোনে তাই বিশ্বাস করে। এবং তারা আবার আতঙ্কগ্রস্তও বটে। আমি যখন ভুল তথ্যে দিয়ে আমাকে ভারাক্রান্ত রাখবো তখন স্বাভাবিক মাত্রায় আমার স্ট্রেস রিঅ্যাকশনটা হবে না। সবসময় আমরা বলবো যে মানুষের এটা মাথায় রাখা উচিৎ যেটা আমার এবং আমার পরিবারের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য না সেটি যেন আমি অন্যের সাথে না করি।’
চিকিৎসকরা মনে করছেন করোনাভাইরাসকে ঘিরে এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকেই করোনা উপসর্গ চেপে যাচ্ছেন, রোগী পালিয়ে যাচ্ছেন যেটা বাংলাদেশে মহামারি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে। সূত্র : বিবিসি