বিপদ চতুর্দিকব্যাপী, নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

0

অসুস্থতা নয়, নিতান্তই সতর্কতাবশত আজ কয়েকদিন ধরে গৃহবন্দি। চারদিকে আতঙ্ক, যদিও সরকার বলছে আতঙ্কগ্রস্ত না হতে। ডজন ডজন ডাক্তার/বিশেষজ্ঞ, সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেতারা নানা পরামর্শ, উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে কাঁচাবাজার খালি, মুদি দোকান খালি। মুড়ি, চিঁড়া, চাল, ডালের দোকান খালি। এমনকি ওষুধের দোকানেও প্রচণ্ড ভিড়। পরিবহনে লোক নেই। রিকশা চলাচল প্রায় বন্ধ, বিভিন্ন দেশে যাতায়াত বন্ধ, ভিসা বাতিল। চারদিক থেকে খবর আসছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সম্পর্কে।

মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে চীন থেকে আগত করোনাভাইরাস কংক্রমিত হয়নি। বলতে বাধা নেই আমার জীবনে, ক্ষুদ্র জীবনে এমন অবস্থা আর কখনও দেখিনি। সাম্প্রতিককালে ‘সার্স’ দেখেছি, চিকুনগুনিয়া নামীয় মারাত্মক রোগের আতঙ্ক দেখেছি। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগ আর দেখা যায়নি। বলতেই হয়, বিশ্বমানবতা আজ অসহায়।

এ রোগের কোনো ওষুধ নেই। এর দ্বারা আক্রান্তের কাছে গেলেই বিপদ। একজন থেকে অন্যজনে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়াচ্ছে এ ভয়ানক রোগ।। সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, ধনী-নির্ধন, শক্তিশালী-শক্তিহীন সবাই অসহায়। ভাবা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে মানবতার এ অবস্থা! মানুষ কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত, ম্যালেরিয়াকে জয় করেছে। মানুষ চাঁদে গিয়েছে কয়েক দশক আগে। মঙ্গলে যাত্রা শুরু হয়েছে। দুনিয়ার যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ‘কমফোর্ট’, ‘প্লেজার’ আজ মানুষের করতলে। আমাদের পূর্ব-পুরুষদের তুলনায় আমাদের জীবন কত ভোগময়।

অথচ প্রকৃতির কাছে আমরা আজ অসহায়। এ ব্রহ্মাণ্ডকে শুধুই মানুষের সুখের অন্তর্গত করতে গিয়ে আমরা প্রকৃতিকে করেছি অবহেলা। তাই কি প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে? জানি না। তবে এ কথা বুঝতে পারছি এখানেই শেষ নয়। এ করোনাভাইরাস বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতিকে তছনছ করে দেবে। আমাদের অর্থনীতিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সারা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি তা থেকে আমাদেরও মুক্তি নেই।

আমরা আজ বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কিত, জড়িত। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্য, সৌদি আরব, ইরান ও ভারত ইত্যাদি দেশ অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক মন্দায় আক্রান্ত হলে তার ছোঁয়া আমাদের গায়ে লাগবেই। আমাদের অগ্রগতি, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।

দেখাই যাচ্ছে উন্নত বিশ্ব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, বাজারকে সচল রাখার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তারা ব্যবসায়ীদের সীমাহীন ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঋণ সুবিধা শুধু নয়, ভর্তুকিও দিচ্ছে। দরিদ্র লোকদের আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। তাদের ঋণ দিচ্ছে। করছাড়েরও ব্যবস্থা করছে। পাওনা টাকা পরিশোধের সময় বর্ধিত করছে। বেকারদের ভাতা দিচ্ছে, সুদবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করছে।

সে সবই কিন্তু বিশ্বমন্দা থেকে বাঁচার জন্য করা হচ্ছে। ২০০৮-০৯ সালের মন্দা থেকে বিশ্ব এখনও মুক্ত হয়নি। এরই মধ্যে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এর ধকল সামলাতে হচ্ছিল আমাদের অর্থনীতিকে। যখন আশার কিঞ্চিৎ আলো দেখা যাচ্ছিল তখন আবার নেমে এসেছে ঘোরতর অন্ধকার।

বর্তমান মন্দার প্রথম শিকার আমাদের গার্মেন্টস শিল্প। বর্তমানে এ শিল্পে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি কারখানা আছে। এর মধে অর্ধেক ভালো করছে। এতে শ্রমিক সংখ্যা ৪০-৪৫ লাখের মতো। দেখা যাচ্ছে এ শিল্প আজ গভীর সংকটে।

বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমরা এখন মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি। ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। অব্যবহৃত কাপড় ধরে রাখতে বলেছে। পণ্য জাহাজিকরণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে পোশাকের দোকান সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার হিসাবে ইতিমধ্যেই ২০০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। সামনে ঈদ। উৎপাদন ও রফতানি বিঘ্নিত।

এফবিসিসিআই নেতারা বলছেন, রফতানিমুখী শিল্পের জন্য অবস্থা খুবই ভয়াবহ। ইউরোপ ও আমেরিকা স্বাভাবিক না হলে রফতানি ভালো হবে না। এদিকে চীন থেকে যে ওভেন খাতের ৬০ শতাংশ পণ্য আসে এবং নিট খাতের ২০ শতাংশ পণ্য আসে সেই বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সংক্ষেপে গার্মেন্ট খাতের এই হচ্ছে অবস্থা। অথচ তৈরি পোশাক খাত আমাদের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ।

অন্য দুটি খাত হচ্ছে রেমিটেন্স ও কৃষি। করোনাভাইরাসের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার স্থবির হয়ে যাচ্ছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে। অনেক মধ্যপ্রাচ্যের দেশে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হচ্ছে। শ্রমিকদের যাতায়াতও হচ্ছে বন্ধ। বলাই বাহুল্য, এ খাত থেকে বর্ধিতহারে যে রেমিটেন্স আসছিল তার ধারা অব্যাহত নাও থাকতে পারে। অথচ এ খাতে আমাদের বার্ষিক আয় ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার।

গার্মেন্টস ও রেমিটেন্সের পর যে বাণিজ্য একদম শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে তা হচ্ছে পর্যটন ও হোটেল ব্যবসা। ঢাকার নামি-দামি সব হোটেল, পাঁচতারা হোটেলে কোনো অতিথি নেই। এসব হোটেলের অতিথি ছিল গার্মেন্টসের ক্রেতা, তাদের এজেন্ট ইত্যাদি শ্রেণির লোক। তৈরি পোশাক খাতের বিপর্যয় এ হোটেল ব্যবসাকে অতিথিশূন্য করেছে। হোটেল ব্যবসায়ীরা প্রচুর লোকশানের আশঙ্কা করছেন।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া, বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা প্রায় প্রান্তিক পর্যায়ে। বহু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ভিসা স্থগিত করা হয়েছে। বিমানের উড্ডয়ন বন্ধ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার মতো কোনো যাত্রী আর অবশিষ্ট নেই। বিদেশ থেকে কিছু বাংলাদেশি জরুরি ভিত্তিতে দেশে আসছে। এমতাবস্থায় পর্যটনশিল্প এক বিপর্যয়ের মুখে।

টোয়াবের সভাপতি বলছেন, বিদেশে যাওয়া এবং বাংলাদেশে আসা বুকিংয়ের শতভাগ বাতিল হয়েছে। এখন অভ্যন্তরীণ বুকিংও বাতিল হচ্ছে। এ সময়ে অনেক দেশি পর্যটক কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুয়াকাটা ইত্যাদি স্থানে যায়। স্থানীয় প্রশাসন ওইসব স্থানে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

ট্যুর অপারেটরদের অনেকে ছাঁটাইয়ের চিন্তা করছে। পর্যটন ও বড় বড় হোটেল ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ও মন্দা। দেখা যাচ্ছে, বিমান কোম্পানিগুলোর অনেকেই লাটে উঠতে যাচ্ছে। এটা বিশ্বব্যাপী ঘটনা। আমাদের বিমান কোম্পানিগুলোরই একই অবস্থা। প্রচুরসংখ্যক যাত্রী ভারতে যেত বিমানে। শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যে যেত বিমানে। মালয়েশিয়া, ব্যাংকক ইত্যাদি দেশেও বিমানে যাতায়াত হতো। এসব এখন বন্ধ।

অতএব, দেখা যাচ্ছে পর্যটন, হোটেল ব্যবসা, বিমান যাতায়াত ব্যবস্থায় এক বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাটে লোকজন কম বেরোচ্ছে, বহু লোক গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। এতে পরিবহন ব্যবসাও মন্দা। অথচ এ খাতের সঙ্গে লাখ লাখ লোক জড়িত। মালিক আছে, ড্রাইভার আছে, হেলপার আছে, গ্যারেজ কর্মী আছে, পার্টেসের দোকানদার আছে, টায়ার-টিউবের ব্যবসায়ী আছে। সবার জন্যই এখন বিপদ।

ঢাকায় অনেকগুলো মেগা শপিং সেন্টার আছে, মল আছে, এ সবে বেচাকেনা শূন্যের কোঠায়। মানুষ হুজুগে জিনিপত্র কিনেছে। এখন সাপ্লাই বন্ধ। ক্রেতাদের গমনাগমনে কড়াকড়ি। যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা সিটি, নিউ মার্কেট, এলিফ্যান্ড রোডের বাজারগুলো এখন জনমানবহীন।

এদিকে শেয়ারবাজারের লড়াদশার কথা সবারই জানা। এ বাজারকে বাঁচানোর জন্য সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। যখন বাজারটি উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা হয়েছিল তখনই করোনাভাইরাসের আগমন। ফলে বাজারের মূল্য পতন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। এ দুর্যোগকালে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে লাখ লাখ হজার, দিনমজুর, রিকশাচালক, বুয়া ও বস্তিবাসী লোকজন। এরা দিন আনে দিন খায়।

একদিনের কাজ না থাকলে তাদের উপোস থাকতে হয়, নতুবা ঋণ করে সংসার চালাতে হয়। দেখা যাচ্ছে এদের রোজগার প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ বাজার হঠাৎ চড়া। তাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি চাল-ডাল, নুন-তেলের মূল্য হঠাৎ করে বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি ইত্যাদির দামও বেড়েছে। একদিকে এরা রোজগারহীন অন্যদিকে বাজারে মূল্য বৃদ্ধি। এই শ্রেণির লোকেরা করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বলাইবাহুল্য দেশের আমদানি-রফতানি ব্যবসা দারুণভাবে বিঘ্নিত। আমাদের আমদানির প্রধান উৎস চীন ও ভারত।

চীনে করোনাভাইরাসের জন্ম। ভারতে লকডাউন চলছে। স্বাভাবিকভাবেই আমদানি ব্যবসা বিঘ্নিত হচ্ছে। অধিকন্তু চাহিদাও রয়েছে কমতি। এদিকে রফতানির প্রধান গন্তব্যস্থল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো। সেসব দেশেও বলতে গেলে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা চালু রয়েছে। অতএব, রফতানির বাজারও সংকুচিত। এর ফল কী? ফল হচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে।

কারণ আমদানি-রফতানি ব্যবসার ওপর সরকারের রাজস্ব নির্ভরশীল। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের মুনাফা না হলে, ব্যবসা না চললে তাদের থেকে আয়কর আদায়ও কমতে বাধ্য। সরকার আগে থেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া শুরু করেছে।

খবর হচ্ছে, ইতিমধ্যেই সরকার ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার ঋণ ব্যাংক থেকে নিয়ে ফেলেছে। করোনাভাইরাসের কারণে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে খেলাপি ঋণের কথা। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হচ্ছে ‘ডিম আগে, না মুরগি আগে’।

ভিন্নভাবে বলা যায়, ব্যবসা আগে, না খেলাপি ঋণ আগে? বলাই বাহুল্য, ব্যবসা ভালো না হলে খেলাপি ঋণ বাড়বেই। চারদিকের যে অবস্থা তাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। অবশ্য সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ঠিক রেখে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ছাড় দিয়েছে। বোঝাই যায় ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর লোকসানের বোঝা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ঘাড়েই চাপে। কারণ বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকাতেই ব্যবসা করে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com