মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত বড় চ্যালেঞ্জ
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সময় পার করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহ হবে করোনার জন্য দেশের খুবই ‘ক্রিটিক্যাল’ সময়। কারণ এ সময়ে দ্বিতীয় দফায় আক্রান্তদের থেকে রোগটি কমিউনিটি লেভেলে তৃতীয় স্তরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এর আগে মার্চের মাঝামাঝিতে ইতালি থেকে ফেরা ১৪২ জনের পাশাপাশি অন্যান্য আক্রান্ত দেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের মাধ্যমে প্রথম দফায় ইতিমধ্যেই রোগটি স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ইতিমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হতে শুরু করায় দেশের জন্য করোনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যা হওয়ার তা আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই হবে। তখনই বোঝা যাবে করোনার প্রকৃত অবস্থা। অর্থাৎ দেশে করোনা কোন অবস্থায় রয়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে হলে এই চলমান ‘ক্রিটিক্যাল’ সময়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। পরে নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হবে। এ সময় তারা বিদেশফেরত ও তাদের সান্নিধ্যে আসা আক্রান্ত ও সন্দেহজনকদের চিহ্নিত করার ওপর জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি রোগীদের শনাক্ত করতে বেশি বেশি পরীক্ষা এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বলেন। এমনকি চিকিৎসক-নার্সদের করোনাযুদ্ধের ‘সৈনিক’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের সুরক্ষা দিতে পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ সময় রোগটি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়বে, চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হবেন এবং রোগীর সংখ্যা বাড়বে।
‘ক্রিটিক্যাল’ সময়ের ব্যাখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ইতালিফেরত ১৪২ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হলো ১৪ মার্চ। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনের ১৪ দিন শেষ হয়েছে ২৮ মার্চ (আজ)। এ সময় আক্রান্ত দেশ, এমনকি যেসব দেশে সামাজিকভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব দেশ থেকেও প্রবাসীরা দেশে ফিরেছে। যেহেতু এসব প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টাইন ঠিকমতো মানানো যায়নি, তাই তারা ঘরে স্বজনদের মধ্যে ও তাদের সান্নিধ্যে এসেছে এমন লোকজনকেও সংক্রমিত করেছে। এরা করোনা বিস্তারের প্রথম সোর্স।
‘দ্বিতীয় সোর্স হিসেবে তাদের সান্নিধ্যে যারা গেছে, তারা আক্রান্ত হয়ে থাকলে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে তৃতীয় স্তরে রোগটি ছড়াবে। সে হিসাবে ১৪ দিন, অর্থাৎ ১১ এপ্রিল বা আরও কিছুদিন দ্বিতীয় স্তর থেকে রোগটি তৃতীয় স্তরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এসব বিবেচনায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় আমাদের জন্য খুবই ক্রিটিক্যাল সময়’Ñ মত দেন এ বিশেষজ্ঞ।
অধ্যাপক ডা.
নজরুল ইসলাম বলেন, এ সময় প্রথমেই সব আক্রান্ত ও তাদের সান্নিধ্যে যারা গেছে, তাদের চিহ্নিত করে আলাদা করে ফেলতে হবে ও কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। এ সময় বেশি মনোযোগ দিতে হবে করোনা পরীক্ষায়। পরীক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে। যাকে সন্দেহ হবে, তারই পরীক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে কমিউনিটি লেভেলে পরীক্ষা বাড়াতে হবে।
এ সময় বিশেষ করে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবেÑ উল্লেখ করে এ ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা যাদের নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, তারাই যদি সুস্থ না থাকেন, তাহলে কাদের নিয়ে যুদ্ধ করব। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পিপিই (পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) দিতে হবে।
একইভাবে এপ্রিলের প্রথম দিককে ‘খুবই ক্রিটিক্যাল’ বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) প্রধান চিকিৎসক ও হাসপাতালের প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, মার্চের মাঝামাঝিতে বিদেশ থেকে যারা এসেছে, তাদের মধ্যে রোগটি পাওয়া গেছে। তাদের সান্নিধ্যে গেছে যারা এখন তারা রোগটি ছড়াবে। বিশেষ করে লকডাউন ঘোষণার পরপরই যারা গ্রামে চলে গেছে, সবচেয়ে বেশি ভয় তাদের নিয়ে। ফলে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে শনাক্তে। যত তাড়াতাড়ি যত বেশিসংখ্যক শনাক্ত করা যাবে, তত বেশি রোগটি ছড়ানো থামানো যাবে। তাছাড়া যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত হবে, তত তাড়াতাড়ি সুস্থও হবে। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, লকডাউন দেওয়ায় ভালো হয়েছে। মানুষজনের ব্যবহারও ভালো। এখন দরকার ডিটেকশন। শনাক্ত করাটাই এখন মূল কাজ।
এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অঘোষিত লকডাউন চলছে দেশে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। কোয়ারেন্টাইন মানতে বাধ্য করা হচ্ছে সন্দেহজনকদের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা নিয়ন্ত্রণে করোনা রোগী শনাক্তে পরীক্ষার পরিধি বাড়িয়েছে। হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট বৃদ্ধিসহ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে। চিকিৎসকদের সুরক্ষায় পিপিই ও পরীক্ষার জন্য কিট সংগ্রহ ও সরবরাহ বাড়িয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় পরিবর্তন এনেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। করোনা পরীক্ষায় দেশজুড়ে ১২টি ল্যাব প্রস্তুতির সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি ল্যাবে ইতিমধ্যেই পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তিনটি ল্যাবে দুয়েক দিনের মধ্যেই পরীক্ষা শুরু হবে।
বিশেষ করে দেশে করোনা সীমিত আকারে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়তে পারেÑ এমন ধারণা থেকে নমুনা পরীক্ষায় পরিবর্তন এনেছে আইইডিসিআর। এ ব্যাপারে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, প্রথমদিকে যারা বিদেশ থেকে এসেছে অথবা করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসে, শুধু তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এখন শুধু তারা নয়, বিদেশফেরতদের সংস্পর্শে আসাদেরও নমুনা পরীক্ষা করছে আইইডিসিআর। এমনকি ৬০-এর বেশি বয়স এবং দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভুগছে এমন কারও যদি করোনার লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়, তবে তাদেরও নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। কী কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে সেটা ডায়াগনসিস করা যায়নি এমন রোগীদের নমুনাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে যেতে হয় এমন মানুষের উপসর্গ দেখা দিলে, তাদেরও নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ডা. ফ্লোরা বলেন, পরীক্ষার ভিত্তিতে আমরা দেখতে চাই বাংলাদেশে কোথাও কোনো সংক্রমণ রয়েছে কি না। আর যেহেতু ঢাকা থেকে অনেকে বাইরে চলে গেছে, তাই জেলা পর্যায়েও হটলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। যেন যেসব জেলায় যারা গিয়েছে তাদের মধ্যেও লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা সংগ্রহ করে অতি দ্রুত বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো যায়।
ধীরে ধীরে রোগের বিস্তার ঘটছেÑ জানিয়ে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, শুরু থেকে রোগের বিস্তারকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে রোগের যত বিস্তার ঘটছে, সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিকে পরবর্তী ধাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে শুরুর দিকে আইইডিসিআরে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছিল, কিন্তু এখন রোগের বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও একটি সমন্বিত কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু রোগের বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই আইইডিসিআরের বাইরেও পরীক্ষা করার প্রয়োজন। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজে (বিআইটিআইডি) পরীক্ষা শুরু হয়েছে এবং নমুনা পরীক্ষাও করা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালের ল্যাবরেটরি প্রস্তুত। যেকোনো সময় সেখানে পরীক্ষা শুরু হবে। আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর নমুনা হাসপাতালগুলোতেই সংগ্রহ করা হবে এবং তারাই আমাদের কাছে পাঠাবে, যাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আইইডিসিআর কর্মীদের নমুনা সংগ্রহ করতে বিলম্ব না হয়।
এদিকে গতকাল দেশে দুজন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। এ দুই চিকিৎসক আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসকদের করোনায় আক্রান্তের তথ্য দিল আইইডিসিআর। তবে চিকিৎসকদের ঝুঁকির কথা শোনা যাচ্ছে অনেক আগে থেকেই। চিকিৎসকরা অভিযোগ করেছেন, তাদের সুরক্ষার সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা সুরক্ষা সরঞ্জাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় সবাই আতঙ্কে আছেন। সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় আতঙ্কে এরই মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সর্দি-জ¦র ও শ্বাসকষ্টের অনেক রোগীকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতেও অনেক জায়গায় ইতিমধ্যে কর্মবিরতি পালন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, যাদের নিয়ে করোনাযুদ্ধ, সেই চিকিৎসকরা যদি নিরাপত্তা না পান, তাহলে যুদ্ধ হবে না। চিকিৎসক-নার্সদের সুরক্ষায় পিপিই সরবরাহ জরুরি। পর্যাপ্ত পরিমাণ পিপিই না থাকলে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় থাকবেন। ফলে ভয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ পিপিই মজুদ আছে। প্রতিদিন পিপিই ব্যবহার হচ্ছে এবং প্রতিদিনই আনা হচ্ছে। আমাদের সিএমএসডিতে পিপিই মজুদ রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এগুলো পাঠানো হচ্ছে। কোনো হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ পেয়ে না থাকলে সিএমএসডি থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। পিপিই নিয়ে কোনো সংকট হবে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, চিকিৎসকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। অথচ আমরা যদি সংক্রমিত হই তাহলে দেশের চিকিৎসা সেবেই ভেঙে পড়বে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে কয়েকজন চিকিৎসক আইসোলেশনে আছেন। তাই রোগী ও তার স্বজনদের প্রতি অনুরোধ, দেশ ও আপনাদের স্বার্থে তথ্য গোপন করবেন না। সঠিক তথ্য দিয়ে সঠিক চিকিৎসা নিন। আমরা অসুস্থ হলে আপনি ও আপনার স্বজনই বিনা চিকিৎসায় ভুগবেন। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এরপরও সবাইকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি দিচ্ছি। প্রতিদিন সকালে সবাইকে নিয়ে আলাদা আলাদা মিটিং করে করণীয় ঠিক করছি। যাদের ফ্লু সমস্যা আছে তাদের ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা দিয়ে আইইডিসিআরে পাঠিয়ে দিয়েছি।