‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’

0

রোম যখন পুড়ছে, সম্রাট নিরো তখন মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছে। এটা বিদেশী প্রবাদ। বাংলা ভাষায় এ ধরনের প্রবাদের অভাব নেই। আজকের জন্য যে প্রবাদটি সবচেয়ে প্রযোজ্য তা হচ্ছে- ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া’। এর মানে হচ্ছে আগুন লেগে প্রতিবেশীর ঘর যখন ছাইভস্ম হয়ে যাচ্ছে তখন একজন আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে সে আগুনেই আলু পোড়া দিলো খাবার জন্য। প্রবাদ বাক্যগুলো আসলে মানুষের বিরল ও বিস্ময়কর আচরণের সাক্ষ্য দেয়। আমাদের নির্বাচন কমিশন এ রকম একটি আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করে। গত শনিবার ২১ মার্চ ২০২০ নির্ধারিত ছিল ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-০৩ এবং বাগেরহাট-০৪ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের। সারা পৃথিবী করোনাভাইরাসে মহামারীতে মহাদুর্যোগে নিপতিত।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এই মহামারীতে আক্রান্ত। চার দিকে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক। দেশে করোনা সংক্রমণে কোভিড-১৯ রোগে প্রথম মৃত্যু সংবাদ সরকারিভাবে দেয়া হয় ১৮ মার্চ। সে দিন মৃত্যুবরণ করে একজন। ২১ মার্চ যখন ঢাকা-১০ সহ উপনির্বাচন চলছে তখন আরেকজনের মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজে। এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২৭। যখন কলামটি প্রকাশিত হবে তখন হয়তো এর সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যাবে। ‘বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা’-ডব্লিউএইচও বাংলাদেশকে অন্যতম সংবেদনশীল দেশ বলে ঘোষণা করেছে। তাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সার্বিক অথবা আংশিক ‘লকডাউন’ এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার সুপারিশ করেছেন। মাদারীপুরের শিবচরসহ দেশের কোনো কোনো এলাকা কার্যত লকডাউনে রয়েছে। সরকারি তথ্য বিবরণীর চেয়ে অবস্থা আরো গুরুতর বলে জনসাধারণ বিশ^াস করে। ভয়ে মানুষ ছুটছে গ্রাম-গঞ্জে। যানজটের ঢাকা এখন একরকম ফাঁকা। সর্বত্র বিরাজ করছে ভীতিকর পরিবেশ। এরকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের বেপরোয়া খায়েশ তারা নির্বাচন করিয়েই ছাড়বেন।

দেশের স্বাস্থ্য রক্ষার সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর বলেছিল, যেহেতু ঢাকা-১০ এর নির্বাচন হবে ইভিএমে সুতরাং এর মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আছে। তার পরও নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন পেছাতে রাজি হয়নি। মানুষের মনে প্রশ্ন, কী জন্য, কার স্বার্থে তারা এই ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার ব্যবস্থা করল? একটা চরম ভীতিকর অবস্থার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ব্যতীত আর কারও আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য সরকারি দলের এই সিদ্ধান্তের একটা তাৎপর্য আছে। তারা কাছের ও দূরের অতীতে যেভাবে ভোটারবিহীন নির্বাচনের তামাশা দেখিয়েছে তাতে ভোটার উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে না। একটা ‘নির্বাচন নির্বাচন খেলা’র আয়োজন করলেই চলে। মানুষের ভোটের দরকার নেই তাদের। দানব রয়েছে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। সে অনুযায়ী করোনাভাইরাস তাদের জন্য আশীর্বাদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ ভোট দিতে না গেলেই তাদের সুবর্ণ সুযোগ। প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকায় ভোট পড়েছে ৫.২৮ শতাংশ। ১৯৭১ সাল থেকে কোনও আসল-নকল নির্বাচনে এত কম ভোট পড়েনি। এটা দৃশ্যমান যে নির্বাচন কমিশন সরকারি দলকে খোলা মাঠে গোল দিতে দিয়েছে। সবাই জানে দুর্যোগময় মুহূর্তে নির্বাচন নব্বই দিন পিছিয়ে দেয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।

গৃহীত নির্বাচনে অতীতের ঐতিহ্যই বহাল রয়েছে। এমনিতেই ঢাকা-১০ আসনের কেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারের খরা। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ঘুরে দেখা যায়, যাদের ঘিরে এত আয়োজন, সেই ভোটারদের দেখা নেই। বেশির ভাগ কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের এজেন্ট ছাড়া ধানের শীষের কেউ ছিল না। আর কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের একক আধিপত্য।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘কেন্দ্রে ভোটারশূন্য, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেয়া এবং জাল ভোট দেয়ার মধ্য দিয়ে ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-০৩ এবং বাগেরহাট-০৪ আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে’। ঢাকা-১০ আসনে প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। একজন ভোটারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের । ইসির সিনিয়র সচিব বলেছেন, বিকেল ৩টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫ শতাংশের মতো। এত কম ভোটের কারণ হিসেবে ইসি সচিব ইভিএমকে দায়ী করেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইভিএমে জাল ভোট না পড়ায় ভোটের হার কম। তিনি আরো বলেন, ভোটার উপস্থিতির দায়িত্ব ভোটারের। তাকে জোর করে আনার সুযোগ নেই। নির্বাচনে কম ভোট পড়ায় বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আসে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ইসির সচিব বলেন, আমাদের আইনে এমন কিছু নেই কত শতাংশ ভোট পড়তে হবে। একটি ভোট পড়লেও সেটিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা হবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় ইসি বিব্রত নয়, এ জন্য ইসি দায়ী নয়। ইসি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে কিনা সেটাই দেখতে হবে। এ দিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, ঢাকার উপনির্বাচনে শতকরা ২ ভাগ ভোটও পড়েনি। তিনি আরো বলেন, আমরা এত করে বললাম নির্বাচনটা বন্ধ করুন। একেবারেই ভোটার নেই। তারপর আবার আমাদের দলের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা-১০, বাগেরহাট ও গাইবান্ধার নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানান। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে মহাসচিব বলেন, ‘এই কমিশন আসলে একটা ক্লাউনে পরিণত হয়েছে। জাতীয় দুর্যোগের মধ্যে তারা এরকম নির্বাচন করে। তাদের নিজেদের যে জায়গা, সাংবিধানিকভাবে তাদের অবস্থানটা কোথায়, সেটি বোঝে না বলে তারা এসব কাজ করে।’ ঢাকা-১০ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ফলাফল প্রকাশের আগেই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপির প্রার্থী রবিউল আলম রবি।

সেই সাথে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার করে নতুন ভোটের দাবি জানিয়েছেন তিনি। বিএনপি প্রার্থী অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, দখল ও কেন্দ্রে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে মানুষ ভোটবিমুখ হয়েছে। গাইবান্ধায় জোর করে নৌকায় সিল মেরে ভোট নেয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপি প্রার্থী মইনুল হাসান ও জাপার প্রার্থী মইনুল রাব্বি। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার দিনভর কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে সরেজমিন উপস্থিতিতে দেখা গেছে, ভোটারের উপস্থিতি কম। কোনো কোনো কেন্দ্র ছিল ভোটারশূন্য। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটার না থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা বসে বসে অলস সময় কাটায়। তিনটি নির্বাচনী এলাকায়ই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বাগেরহাট-০৪ আসনে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না। ভোটের আগেই ঋণখেলাপি হওয়ার অভিযোগ দিয়ে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থিতা বা নৌকা প্রতীক তাদের বিজয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে আসছে। এর কোনো ব্যতিক্রম খুব কমই ঘটেছে।

ভোটারশূন্য নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনের বোধোদয় ঘটেছে। দেশে সব ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ভাইরাসটির প্রকোপ থাকা পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। এই হিসেবে আগামী ২৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন-চসিক নির্বাচন, জাতীয় সংসদের বগুড়া-০১ ও যশোর-০৬ আসনে উপনির্বাচন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কাউন্সিলসহ সব ধরনের নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ থাকা পর্যন্ত ২১ মার্চের পর থেকে আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না দেশে। নির্বাচন সচিব বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে এবং বর্তমানে করোনায় দেশে কয়েকজনের মৃত্যুতে নির্বাচন কমিশন সব নির্বাচন স্থগিত করেছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন বলবে আর ঝুঁকি নেই তখনই আমরা নির্বাচন করব। এ ক্ষেত্রে যে পর্যায়ে এসে নির্বাচন স্থগিত করা হলো, সে পর্যায় থেকেই আবার নির্বাচন কার্যক্রম শুরু হবে। এ জন্য নতুন করে মনোনয়ন নেয়া হবে না। যারা প্রার্থী আছেন তারাই থাকবেন। এ সিদ্ধান্তের পর সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, যে যুক্তিতে নির্বাচন এখন স্থগিত করা হলো সেই একই যুক্তিতে গত শনিবারের নির্বাচন কেন স্থগিত করা হলো না? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য করছেন যে, সরকারকে মৌলিক রাজনৈতিক সুবিধা দেয়ার পর নির্বাচন স্থগিতকরণের ঘোষণা একটি রাজনৈতিক প্রতারণা। আর যদি উপলব্ধির কথা আসে তাহলে বলতে হয়, সাত ঘাটের পানি খাওয়ার পর যাদের বোধোদয় হয় তারা কি জাতীয় দায়িত্ব পালনে সক্ষম?

নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের দায়িত্বহীন এবং দলনির্ভর সিদ্ধান্ত অতীতের নির্বাচনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ইভিএম বনাম কাগজের ব্যালটের যে পার্থক্য শনিবারের নির্বাচনে দেখা গেল তার তেলেসমাতি কী? ইসি সচিব বলেছেন, জাল ভোট না পড়ায় ইভিএমে কম ভোট পড়ে।

এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কি নির্বাচন কমিশন স্বীকার করে নিয়েছে যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৩টি আসনে জাল ভোট হয়েছে? যদি সেটি স্বীকার করে নিয়ে থাকে তাহলে তারা এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? ইসি সচিব এমনটি দাবি করলেও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমেও জালিয়াতির অভিযোগ ছিল, সেটি সবারই জানা কথা। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। নাগরিক সাধারণের আশা ছিল সবশেষে তারা অন্তত আইনের শাসন প্রয়োগ করবেন। আর সব দেশের মতো আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হয়েছে। এই স্বাধীনতার অর্থ হলো, কোনো ধরনের অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে তারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্য দিয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি প্রকাশিত হবে।

ণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণ হচ্ছে এই সম্মতি বা নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে। এটাই গণতন্ত্র, এটাই নিয়মতান্ত্রিক পথ। কিন্তু অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিগত বছরগুলোতে নির্বাচন ব্যবস্থার সর্বনাশ সাধন করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থার এই বিপর্যয়ে যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। 

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com