এ যেন নির্বাচন নির্বাচন খেলা
বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ এবং বাগেরহাট-৪ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করল। ঢাকা-১০ আসনে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। আইইডিসিআর বলেছিল, ইভিএমের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন করতে পিছপা হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তাদের কেন এই হাস্যকর নির্বাচন করতে হলো? কার স্বার্থে এবং কেন এই নির্বাচন?
এই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে কোনো আগ্রহই ছিল না। বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁরা সারা দিন ওত পেতে বসে ছিলেন, কখন একজন ভোটার আসবেন। একজন ভোটার ভোট দিতে এসেছেন, এটাই যেন এখন বড় সংবাদ! বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী ঢাকায় ভোট পড়েছে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। এটা ইতিহাসে রেকর্ড। এর আগে কোনো জাতীয় নির্বাচন বা উপনির্বাচনে এত কম ভোট পড়েছে বলে আমার জানা নেই। এ রকম একটি রেকর্ড সৃষ্টি করার জন্য নির্বাচন কমিশন অভিনন্দন পেতেই পারে! কারণ, ভোটার খুঁজে বেড়ানোর এই নির্বাচন ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে।
গাইবান্ধা ও বাগেরহাটে ভোটের হার তুলনামূলক বেশি ছিল। ইসি বলেছে, দুপুর পর্যন্ত ওই দুটি আসনে ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। এই দুটি আসনে ভোট হয়েছে কাগজের ব্যালটে। ঢাকা-১০–এর সঙ্গে এই দুই আসনে ভোটের হারের যে বিশাল ব্যবধান, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সেখানে দেখা গিয়েছিল, কাগজের ব্যালটে ভোট পড়েছিল ৮১ শতাংশ। আর যে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল, সেখানে ভোট পড়েছিল গড়ে ৫১ শতাংশ। ইভিএম বনাম কাগজের ব্যালটের এই পার্থক্যের তেলেসমাতি কী—ইসির কাছে একটি ব্যাখ্যা দাবি করছি। অবশ্য ইসি সচিব গতকাল শনিবার বলেছেন, জাল ভোট না পড়ায় ইভিএমে ভোট কম পড়ে। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কি নির্বাচন কমিশন স্বীকার করে নিয়েছে যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৩টি আসনে জাল ভোট হয়েছে? যদি সেটা স্বীকার করে নিয়ে থাকে, তাহলে তারা এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
অবশ্য ইভিএমে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই, এমনটা ইসি দাবি করে এলেও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমেও জালজালিয়াতির অভিযোগ আমরা শুনেছি।
গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন। একটি সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের এই সম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু মাত্র ৫ শতাংশ ভোটে জনগণের সে সম্মতি আসলেই প্রতিষ্ঠিত হয় কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হয়েছে। এই স্বাধীনতা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করা। নির্বাচন কমিশন কোনো পোস্ট অফিস নয়। তাদের দায়িত্ব জনগণের সম্মতির বিষয়টি যথাযথভাবে নিশ্চিত করা। এই যে ভোটারখরা, ভোটার অনুপস্থিতি—এসবের দায় নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
অতীতের বিভিন্ন নির্বাচন এবং এই নির্বাচন থেকে এটা সুস্পষ্ট যে নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার পরিবর্তে নির্বাচন নির্বাচন খেলায় মত্ত হয়েছে। এর আগে আমরা খুলনাসহ পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মডেল দেখেছি। গত জাতীয় নির্বাচনে আগের রাতে ভোট করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই কমিশন। এভাবে তারা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকেই প্রহসনে পরিণত করেছে।
এবার এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এই কমিশন মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা মানুষের জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ ধরনের একটি জনস্বার্থ পরিপন্থী প্রচেষ্টা বিরল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এমন স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণের মধ্যে আমরা নাগরিক সমাজ নীরব দর্শকে পরিণত হয়েছি।
সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)