ব্রিটেনে করোনার ভয়াবহ অবনতি : মসজিদ, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা, জিম বন্ধ
ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। গতকাল এক দিনে মারা গেছে ৩৩ জন। এ নিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত ব্রিটেনে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই রোগে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯৮৩ জন। এমন পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধের পর প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রেস্টুরেন্ট, পাব, নাইট ক্লাব , ক্যাফে, থিয়েটার, সিনেমা, জিম এবং লেজার সেন্টার দ্রুত বন্ধ করতে বলেছেন। শুক্রবার এক প্রেস কনফারেন্সে ব্রিটিশ জনসাধারনকে ওই আহবান তিনি। একইসাথে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বেরুতে জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে চার্চ অব ইংল্যান্ড করোনার কারণে যেকোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৫ জন উপস্থিত থাকতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এনএইচএস ইংল্যান্ডের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত সর্বশেষ মৃতদের বয়স ছিলো ৫০ থেকে ৯৯ বছরের মধ্যে এবং তারা মূলত বার্ধক্যজনিতসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। মৃতদের পরিবারকে তাদের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। শুক্রবার মৃত ৩৯ জনের মধ্যে ১৭ জন রাজধানী লন্ডনের বলে জানায় এনএইচএস ইংল্যান্ড।
এদিকে ব্রিটেনের করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব বেড়ে যাওয়ায় ইংল্যান্ড,স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের স্কুলগুলো পরবর্তী নিদের্শনা দেয়া পর্যন্ত শুক্রবার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এনএইচএস, সোস্যাল ওয়ার্কার, টিচার্স এবং ফুড ডেলিভারির করেন এধরনের পিতামাতাদের শিশুদের জন্য স্কুল খোলা থাকবে। এছাড়াও দেশটির এ-লেভেল এবং জিসিএসই পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, করোনা ভাইরাস মোকাবেলা ও সেবা বৃদ্ধি করার জন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের ৬৫ হাজারেরও বেশি অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সদের এনএইচএসে কাজে ফিরে যেতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মানুষের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ ১২ সপ্তাহের জন্য কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু করোনা বিষয়ে ব্রিটেনের সরকারের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মানুষের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ আরো বেশি সময়ের জন্য বন্ধ রাখা দরকার। প্রয়োজন হলে ওই যোগাযোগ এক বছর পর্যন্ত বন্ধ করা যেতে পারে।
এদিকে ব্রিটেনের ইতিহাসে সরকার এই প্রথম বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে যাচ্ছে। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যুক্তরাজ্যের সকল পাব-রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, থিয়েটার, জিম ও লেজার সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দেয়ার পর চ্যান্সেলর ঋষি সুনাক ভর্তুকি সংক্রান্ত ঘোষণা দেন।
চ্যান্সেলর ঋষি সুনাক তার ঘোষণায় বলেন, মহামারী করোনাভাইরাস জনিত কারণে নজিরবিহীন এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে মানুষের চাকরি ও ব্যবসা সুরক্ষার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। চ্যান্সেলর বলেন,এই ঘোষণাটি সরকারের শ্রমিকদের পাশে দাড়াঁনো ও চাকরী বাঁচানোর একটি জাতীয় প্রচেষ্টা। তিনি করোনভাইরাসের এই সংকটময় মুহূর্তে নিয়োগকর্তাদের তাদের কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
বিভিন্ন সংস্থা সতর্ক করে বলেছিল যে করোনা ভাইরাস দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ধ্বস আনবে এবং হাজার হাজার মানুষ চাকরী হারাবে, যা যুক্তরাজ্যের জীবনযাত্রায় বিরুপ প্রভাব ফেলবে। সুনাক বলেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের ফলে ব্যবসায়ের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। চ্যান্সেলরের মজুরি প্যাকেজটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কর্মচারীদের উপর বোঝা কমিয়ে আনার জন্য সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপ। যা প্রতিমাসে রিভিউ বা পুনর্বিবেচনা করা হবে
ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ব্রিটেন সরকার। এজন্য ২০ হাজার সেনা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বুধবার রাতে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় সেনা সদস্যদের রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে। পথচারীরা সেনাসদস্যদের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছেন। সেনাবাহিনী রাস্তায় দেখে জনমনে কিছুটা স্বস্তি আসছে ।
দৈনিক গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, পুলিশ ও এনএইচএস স্টাফদের সহযোগিতা করাই হবে সেনাবাহিনীর মূল কাজ। এসব ব্যাপারে সেনাবাহিনীরা প্রশিক্ষিত। এনএইচএস কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে আর্মির ডাক্তাররা রোগীদের সেবা দেবেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন হোটেল, কমিউনিটি সেন্টারকে সাময়িক হাসপাতালে রূপান্তরিত করে সেখানে চিকিৎনা দেয়া হবে। সর্বোপরি গোটা দেশ লকডাউন বা বন্ধ করে দেয়া হলে সম্ভাব্য লুটপাট প্রতিরোধে রাস্তায় থাকবে সেনাবাহিনী।
স্কুল বন্ধের পাশাপাশি আগামী মে ও জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্ধারিত পরীক্ষাগুলোও স্থগিত করা হয়। এই পরীক্ষা কী জুন-জুলাই মাসে হবে নাকি এই বছর হবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি বরিস জনসন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বছর শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই তাদের ফলাফল পাবার অধিকার রয়েছে, কিন্তু কীভাবে তারা তা পাবে সেটিও পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তবে এ বছরের পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণায় খুশি নন অনেক শিক্ষার্থী। কারণ অনেকে মনে করছে, পরীক্ষা হলে হয়তো তারা ভালো গ্রেড নিয়ে পাশ করতে পারতো। পরীক্ষা না হওয়ার ঘোষণায় এখনো পরিষ্কার নয়, তাদের ফলাফল কীভাবে নির্ধারণ হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী অচিরেই বিস্তারিত জানা যাবে বলে উল্লেখ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রধান সায়েন্স এডভাইজার ও প্রধান ক্লিনিক্যাল অফিসার উপস্থিত ছিলেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশুদের বৃদ্ধ দাদা-দাদি বা বয়স্ক আত্মীয়দের সাথে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়, যারা বিশেষভাবে করোনভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তিনি অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষক ও স্টাফদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি তাদের আত্মত্যাগের জন্য পরিবারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। একই সাথে আমি শিক্ষক এবং সকল সাপোর্টার কর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে চাই যারা স্কুলগুলি চালিয়ে যায়।
দ্যা গার্ডিয়ানের খবরে আরো বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে সিঙ্গেল লাইন ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে। শুক্রবার থেকে ওয়াটারলো এন্ড সিটি লাইন বন্ধ করে দেয়া হবে। শুক্র ও শনিবার থেকে রাতের বেলা জনসাধারনের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। রাতের বেলা ট্রেনে শুধু জরুরি বিভাগে কর্মরত স্টাফরা চলাচল করবেন।
মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ
অন্যদিকে এত দিন ব্রিটেনের মসজিদগুলো খোলা থাকলেও ১৮ মার্চ অধিকাংশ মসজিদই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোপুর্বে ক্যাম্ব্রিজ ইকো মসজিদসহ কয়েকটি মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বুধবার রাতে এশার নামাজের পর ইমাম আব্দুল কাইয়ুম পর দিন বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ইস্ট লন্ডন মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমার আনুষ্ঠানিক জামাত বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করেছেন।
এদিকে একই সময়ে লন্ডন মুসলিম সেন্টারের সেমিনার হলে কাউন্সিল অব মস্ক টাওয়ার হ্যামলেটসের এক বৈঠকে টাওয়ার হ্যামলেটসের ৪৫টি মসজিদ বন্ধ করার ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা হয়। আলোচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি মসজিদেই আনুষ্ঠানিকভাবে জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ থাকবে। মুসল্লিদেরকে ঘরে নামাজ পড়তে তাগিদ দেয়া হয়েছে। তবে মসজিদগুলোতে সময়মতো আজান দেয়া হবে। নামাজ কায়েম রাখার স্বার্থে হয়তো একেবারে স্বল্প পরিসরে জামাত হতে পারে।
বুধবার ব্রিকলেন জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব সাজ্জাদ মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি শুনেছেন অন্যান্য মসজিদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তবে তাঁরা বৃহস্পতিবার কমিটির সভা ডেকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই মসজিদের ইমাম বয়োবৃদ্ধ মুসল্লিদেরকে মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ পড়ার তাগিদ দিয়েছেন।