করোনা আতঙ্ক কতটুকু শিক্ষা নিতে পেরেছে বাংলাদেশ?
করোনাভাইরাস নামে বহুল পরিচিত কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বর্তমান সময়ের ভয়াবহ একটি আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আকস্মিক দাপটে পুরো বিশ্ব যেন নতজানু হয়ে পড়েছে, মুখ থুবড়ে গেছে বিশ্ববাসীর স্বাভাবিক জীবনের গতিময়তা।
এসব কিছুর মাঝে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন নাড়া দেয়, করোনাভাইরাসের ঝুঁকি আসলে এদেশে কতটুকু? আর ঝুঁকি যদি থেকেই থাকে, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি আদৌ প্রস্তুত?
সপ্তাহ দুয়েক আগেও মালয়েশিয়াতে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল অল্প সংখ্যক। জনজীবনও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে মালয়েশিয়াতে তাবলীগ জামায়াতের দুটি বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দুটি সমাবেশে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ সমবেত হয়। এ দুটি সমাবেশের পরপরই মালয়েশিয়াতে এখন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকহাজার ছাড়িয়ে গেছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকটা জরুরী অবস্থা বিরাজ করছে।
অন্যদিকে প্রথম থেকেই করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। কিন্তু ইরানের সরকার প্রথম থেকে ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিল না। কারণ, তারা যদি প্রথম থেকেই ব্যাপারটাকে গূরুত্ব দিয়ে দেখতো তবে আর ব্যাপকভাবে ইসলামি বিপ্লব দিবস পালন করা সম্ভব হতো না। ফলে ১৬ জানুয়ারী সর্বত্র ইরানজুড়ে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে ইসলামি বিপ্লব দিবস পালন করা হয়। .
এরপরই ইরানে করোনা আসল রূপে আর্বিভূত হতে থাকে। ইরানে এখন পর্যন্ত ১৬ বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যুবরণ করেছে ৯৮৮ জন।
উপরের দুটো ঘটনা বললাম, কারণ আমাদের দেশের সরকার এগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারও ইরানের সরকারের মত ঘাড় ত্যাড়ামো করে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে, জনসমাগম ঘটিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিন উদযাপন করল।
এতো আয়োজন করে জন্মদিন পালন করার পর আজই পত্রিকায় সংবাদ পেলাম- করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে ব্যাপক সংক্রমণ ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হয়েছেন, যার মধ্যে দু’জন শিশু এবং ইতোমধ্যে একজন মারাও গেছেন। এই সংবাদ পড়ে আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছি একদল হুজুরের কান্ড দেখে।
যেখানে সৌদি আরবের শরিয়া কাউন্সিল কাবা ঘর তাওয়াফ বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানকার মসজিদগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে লক্ষীপুরে একদল আলেম গণজামায়াত ঘটিয়ে আল্লাহর কাছে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য দু’ আ করছেন! আরে এই দু’আ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি মেলা তো দূরের কথা, বরঞ্জ এর মাধ্যমে ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেছে- তা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়।
বর্তমান যে প্রেক্ষাপট, তাতে বাংলাদেশ মোটেও করোনা ঝুঁকিমুক্ত নয়। ঘনবসতিসম্পন্ন এই দেশে মানুষের দৈনন্দিন জীবন এখনো চলছে সমান তালে। করোনা ঝুঁকি প্রতিরোধে জনগণের মাঝে আছে দায়সারা মনোভাব। অন্যদিকে সরকারের উপর মহলের নেতারা লোকসমাগম ঘটিয়ে হাসপাতাল উদ্বোধন করছে।
শুধু তাই নয় করোনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনেও৷। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, ‘‘মুজিববর্ষ পালনের ডামাডোলে সরকার জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করেছে, দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে৷” তিনি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখারও দাবি জানিয়েছেন৷
সরকারের ভাষ্য মতে, দেশে ইতিমধ্যে প্রতিটি হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইন প্রস্তুত করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইনে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। প্রবাসফেরত কেউ আক্রান্ত হয়ে যাতে অন্যদের কাছে এ ভাইরাস ছড়াতে না পারে, সে ব্যাপারেও সরকারকে কঠোর অবস্থান অনুসরণ করতে দেখা গেছে। এ রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করতে যেসকল সরঞ্জামাদি এবং সুবিধা দরকার, তা আছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা ঠিক নেই। যদিও এখন পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কোনোভাবে যদি তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা প্রতিরোধের সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই।
তাদের মতে, কোয়ারেন্টাইনগুলোতে যথাযথভাবে নিয়ম পালন করা হচ্ছে না। একসাথে এমনভাবে মানুষ রাখা হয়েছে, যাতে খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনে করোনা সংক্রমণ ঘটতে পারে। একই টয়লেট ব্যবহার করছেন সবাই। খাবারও খাচ্ছেন একসাথে। অথচ কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার প্রথম শর্ত হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬ জনকে একসঙ্গে একরুমে রাখা যাবে।
সরকার অনেকটাই ভুল পথে এগোচ্ছে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, আমেরিকার ২০টি বিমানন্দরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যাত্রীরা আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারে। কোয়ারেন্টাইনে সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৬ জনকে একসঙ্গে রাখা যায়। এর বেশি হলে সেটা কোয়ারেন্টাইন নয়।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় কর্মসূচিও কাটছাঁট করছে৷ তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাজারে৷ মাস্ক, স্যানিটাইজারের মত প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক পণ্যের অভাব দেখা দিয়েছে৷ বেড়েছে দামও৷ ব্যবসা ধরতে ঢাকার কেরাণিগঞ্জে রাতারাতি গড়ে উঠেছে কাপড়ের মাস্ক তৈরির অনেক কারখানা৷ যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে সবার মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই৷ বাজারে মাস্কের পরই সবচেয়ে বেশি চাহিদা ‘হ্যান্ড ওয়াশের’৷
চীন ও ইতালি থেকে এত মানুষকে এই মুহূর্তে দেশে আনা উচিৎ হয়নি, তারা সেখানেই ভালো ছিলেন, এটা তাদেরই স্বীকারোক্তি। কোয়ারেন্টাইন নিয়ে ব্যবস্থাপনাটাও সঠিক করা জরুরি ছিল। যদিও সরকার বলছে এদের কেউ আক্রান্ত নয়। অস্ট্রেলিয়া তাদের লোক ফিরিয়ে নিয়ে নির্জন দ্বীপে রেখেছে। এদিকে আমরা অনেক জনবহুল একটি দেশ। আর এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুসারে এপিডেমিওলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট, এনভায়রনমেন্টাল, মেডিসিন স্পেশালিস্টের সমন্বয়ে একটি টিম করে কাজ করা উচিৎ।
সরকারি উদাসীনতা, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ধীরে ধীরে মহামারিতে ধারণ করছে এই ভাইরাস। কোয়ারেন্টাইনে রাখা গেলে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণে থাকতো। দ্রুত রোগ শনাক্ত আর আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। শুরুতেই ঘাটতি ছিল পরিকল্পনায়। প্রথমেই বিমান চলাচল ব্লক ডাউন করে অথবা আক্রান্ত দেশে ১৪ দিনের মধ্যে ভ্রমণ করেছে এমন ব্যক্তি আটকে দিয়ে করোনা প্রবেশ রোধ করা যেতো। কিন্তু সরকারি ভাবে তখন এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে দেখা যায়নি। এতো কিছুর পরেও শিক্ষা নিতে পেরেছে কি বাংলাদেশ?