ভারত এখনো উদীয়মান পরাশক্তি হয়নি
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার পররাষ্ট্রবিষয়ক তৎপরতার ফলে সুনির্দিষ্টভাবে কী লাভ হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে যে বিপুল উদ্দীপনা ও গতির সঞ্চার হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। তার উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক কূটনীতির মাধ্যমে ভারতের সফট পাওয়ার সম্প্রাসরণ, মধ্যপ্রাচ্যে কার্যকর সম্পৃক্ততা, প্রবাসী ভারতীয়দের কাছাকাছি যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন।
অনেকটা একই কারণে মোদি গত বছর যখন পুনঃনির্বাচনের প্রয়াস চালাচ্ছিলেন, তখন পররাষ্ট্রনীতি নীতিনির্ধারণী মহল ও সাধারণ মানুষ- উভয় পর্যায় থেকে অনেক বেশি প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষা জাগে। মোদি বিশ্বে ভারতের মর্যাদা বাড়িয়ে চলেছেন, এমন ধারণাও তার দ্বিতীয় মেয়াদে বিপুল জয়ের অন্যতম কারণ।
তবে মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার এক বছর পার হওয়ার আগেই এমন সব ঘটনা ঘটছে, যার ফলে স্থিতিবস্থা বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো বাড়ছেই, বিশেষ করে স্থানীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বেশি কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সরকারের নিজের ভুলে। সেইসাথে জাতীয় অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ভ্রান্তির ফলেও কিছু ঘটনা ঘটেছে। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করা হয় দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে। যদি বর্তমান ধারা নির্ভরযোগ্য সূচক হয়ে থাকে তাহলে বলা যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তার নিজের ঘরোয়া ও সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে জিম্মি করে।
ভারতের ‘উদীয়মান বিশ্বশক্তি’ হওয়ার ধারণাটি বৃহত্তর পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পায় ২০১০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরকালে। তিনি নাটকীয়ভাবে বলেছিলেন যে ভারত কেবল উদীয়মান শক্তিই নয়, ইতোমধ্যেই উদিত হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ভারতের গলাবাজীপূর্ণ বিকাশ দেখানো হলো উদীয়মান চীনকে প্রতিরোধ করার মার্কিন কৌশলের অংশবিশেষ। অবশ্য ওমাবার বিবৃতিতে ভারতকে সক্ষম ও দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে ধরে নেওয়ার বিষয়টিও সম্পৃক্ত ছিল। এই ধারণা কেবল ভারতের স্থিতিশীল ও দৃঢ় অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে ছিল না। ২০০৯ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৯.৮ হারকে স্পর্শ করেছিল। অন্য যেসব কারণ ছিল তার মধ্যে ছিল ভারতের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক পরিচিতি, অর্জন এবং সেইসাথে বহুত্ববাদ, বহু সংস্কৃতিবাদ, সেক্যুলারবাদ, সহিষ্ণুতা ও আন্তর্জাতিক শান্তির মতো মূল্যবোধ ও আদর্শ সমুন্নত রাখার ব্যাপারে দেশটির সাফল্য। এসব কিছু অবধারিত বিষয় মনে হলেও এগুলোই ভারতের উদীয়মান পরাশক্তি মর্যাদার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছিল।
আর ভারতের ঘরোয়া রাজনীতি দৃশ্যত এর পররাষ্ট্রনীতিকে বিভিন্ন দিকে পরিচালিত করছিল। আবার মোদি প্রথম আমলে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাকে নেহরুর সাথে তুলনা করা হচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ভারতের ভাবমূর্তি নির্মাণে মোদি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, এখন তিনিই এর অনেকগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন।
নতুন পররাষ্ট্র চ্যালেঞ্জগুলো ঘরোয়া রাজনৈতিক উদ্বেগে পরিচালিত হচ্ছে। সম্প্রতি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রণয়ন করে সরকার ভারতের ঐতিহাসিক আদর্শ ও বহুত্ববাদ ও সেক্যুলার মতাদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।
সেইসাথে সিএএর বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতাকে দমন করতে আগ্রাসী শক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এর বিরোধিতা দেখা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের বিপুল চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক দেশ এখন নীরবতার অবসান ঘটিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে।
তাছাড়া গত বছর জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিলের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ভারত এগুলোকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলেও তাতে পার পাওয়া যাচ্ছে না।
এবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতকে নিয়ে যে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য যে ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যাচ্ছে না। উল্টা বিজেপি ও আরএসএস তাদের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শই আরো তীব্র করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এর ফল ভালো হওয়ার কথা নয়, এবং হয়ওনি। নিজ দেশে যদি মুক্ত, স্বাধীন ও অন্তর্ভক্তিমূলক আদর্শ না থাকে তবে ওইসব আদর্শভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিক ঘোষণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাভাবিকভাবেই সাড়া ফেলে না। উদার গণতন্ত্রের চেতনার সাথে থাপ খায় না ভারতের সাম্প্রতিক ঘরোয়া নীতি। ভারতের বিশ্ববীক্ষা আসলে কী, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।