হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে ভারতের কোণঠাসা সংখ্যালঘুরা
ভারত সরকার ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে যখন দেশের বৈচিত্র্য প্রদর্শন করছিল, তখন বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার লোক কলকাতায় ভারতীয় সংবিধানের প্রতি তাদের বিশ্বাস সমুন্নত রাখতে ১১ কিলোমিটার লম্বা মানববন্ধন করে।
মানববন্ধনটির আয়োজক ইউনাইটেড ইন্টারফেইথ ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক সাতনাম সিং আহলুওয়ালিয়া বলেন, বিজিপি সরকারের অধীনে দেশের সংখ্যালঘুদের অনেকে ক্ষুব্ধ। সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে। আমরা চাই, ওই অধিকার যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, পারসি ও জৈনদেরকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ওপর হিন্দু গ্রুপগুলোর আক্রমণ বেড়েছে। শিখ ও বৌদ্ধরাও আক্রান্ত হচ্ছে।
শিখ ধর্মাবলম্বী আহলুওয়ালিয়া বলেন, সবার মধ্যে ভয় যে তারা আজ মুসলিমদের টার্গেট করছে, কাল তারা অন্য সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করবে।
ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের মতে, ২০১৬-২০১৯ সময়কালে ভঅরতজুড়ে সংখ্যালঘু ও নিম্নবর্ণের দলিতদেরকে হয়রানি করার জন্য ২০০৮টি মামলা হয়েছে।
গত বছর মোদি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ১৯ লাখ লোক রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে তাদের নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসি) না থাকায়। সারা ভারতে এনআরসি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তারপর আসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এতে প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।
ভারতে প্রায় ২০ কোটি মুসলিম বাস করে। তারাই দেশটির বৃহত্তম সংখ্যালঘু গ্রুপ। আশঙ্কা করা হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি একযোগে প্রয়োগ করা হলে তারা বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগে বাধ্য হবে।
দিল্লি মাইনরিটিস কমিশনের চেয়ারম্যান জাফরুল-ইসলাম খান বলেন, অন্যন্য ধর্মের লোকজন যদি তাদের জাতীয়তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলেও তারা প্রতিবেশী তিন দেশের হলে সিএএর অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করবে পারবে। কিন্তু মুসলিমদের জন্য ওই সুযোগ থাকছে না।
বিজেপির পিতৃ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) মুসলিমদেরকে ‘হানাদার’ মনে করে। একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯২৫ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তার ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী গ্রন্থে লিখেন যে আরএসএসের সাবেক প্রধান এম এস গোলওয়ালকার বলেছেন যে অহিন্দু লোকজন দেশে থাকতে পারবে, তবে তাদেরকে পুরোপুরি হিন্দু জাতির অধীনে থাকতে হবে, তাদের এমনকি নাগকির অধিকার পর্যন্ত থাকবে না।
ভারতের সংখ্যালঘুরা আশঙ্কা করছে, মোদির অধীনে সেটিই হতে যাচ্ছে।
ভারতের খ্রিস্টান সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ। তারাও চার্চ ও পুরোহিতদের ওপর ক্রমবর্ধমান হামলার বিষয়টি লক্ষ করছে। হিন্দু গ্রুপগুলো তাদের প্রার্থনা অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। জোরপূর্বক হিন্দুত্বে পুনঃধর্মান্তকরণের ঘর ওয়াপসি অনুষ্ঠান নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
পারসিকিউশন রিলিফ নামের একটি এনজিওর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ অপরাধ ৫৯.৫ ভাগ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, তামিল নাড়ু, কর্নাটকে।
ব্যাঙ্গালোরের মেট্রোপলিটান আর্চবিশপ পিটার ম্যাচাদো বলেন, আমাদের প্রতি বিজেপি বেশ প্রতিবন্ধকতাময়।
কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডি সুজা বলেন, সংবিধানের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধাবোধের অভাবের মধ্যেই সমস্যা নিহিত।
কেবল মুসলিম ও খ্রিস্টানরাই মোদির অধীনে কোণঠাসা মনে করছে না। প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ শিখও আশঙ্কা করছে বিজেপি ও আরএসএস তাদেরকে তাদের এজেন্ডায় একীভূত করতে চাচ্ছে।
আরএসএস-পরিচালিত রাষ্ট্রীয় শিখ সংগতের (তাদের লক্ষ্য হিন্দুদের সাথে শিখদের ঐক্যবদ্ধ করা) বিরোধিতা করছে শিখেরা। তাছাড়া হিন্দু রাষ্ট্র ধারণাটি শিখ নেতাদের পছন্দ নয়।
দিল্লি শিখ গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি মানজিন্দার সিং সিরসা বলেন, এটি একটি সেক্যুলার দেশ। এখানে কিভাবে কারো উপর কোনো ধর্ম চাপিয়ে দেয়া সম্ভব। তারা কিভাবে বলে যে আমরা হিন্দু?
সিরসা ২০১৭ সালে বিজেপির মিত্র শিরমনি আকালি দলের প্রার্থী হিসেবে দিল্লিতে আইন পরিষদের আসনে জয়ী হয়েছেন। তিনি দিল্লির নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে তিনি হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা সমর্থন করেন না।
বিজেপির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বর্তমানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সম্প্রতি সিএএর বিরুদ্ধে শাহিন বাগে প্রতিবাদরতদের সাথে যোগ দেয় শিখদের একটি কৃষক গ্রুপ।
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আশুতোষ কুমার বলেন, শিখদের শাহিন বাগ যাওয়াতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে তারাও বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দেশটির ৮.৪ মিলিয়ন বৌদ্ধদের দিকেও মনোযোগী হয়েছে। তাদেরকেও তারা তাদের মধ্যে সামিল করতে চায়। আবার মহারাষ্ট্রসহ কয়েকটি স্থানে বৌদ্ধদের ওপর হামলাও হয়েছে। বৌদ্ধ পুরোহিতদের জাতীয় সংস্থা ভারতীয় সঙ্ঘরাজা ভিক্ষু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক প্রিয় মাহাথেরো বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়ই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে গিয়ে ভালো ভালো কথা বলে আসেন। আমি তাদেরকে বলি, তারা কেন ভালো ভালো কাজ করে না, যাতে আমরা তাদের প্রশংসা করতে পারি?
প্রশ্ন হলো, মোদির সরকার কি এসব কথা শুনবে?