ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিরোধ কেন

0

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারত সফরে যাচ্ছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেশ কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেও ট্রাম্পের এটিই প্রথম ভারত সফর। এদিকে টেক্সাসে বহুল আলোচিত হাউডি মোদির বেশ কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। দুই দেশই বারবার বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করলেও তা কার্যকর হয়নি, বরং শুল্ক নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে টেনশন বেড়েছে।

আমেরিকার সাথে ভারতের বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ কেন
ভারতের বর্তমানে স্থগিত দ্বিপক্ষীয় শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি গত বছর থেকে সরকারের নজরে পড়েছে। যদিও সাত বছরের পুরনো এই চুক্তি শেষ করতে চেয়েছিল ভারত, তাদের সামনে ছিল আরসেপ, বিশ্বের বৃহত্তম আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি।

কিন্তু নভেম্বরে আরসেপ থেকে বেরিয়ে এসে ভারত বৃহৎ সুসংহত বাজারের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। এবার ভারতের উপর চাপ হলো, আরসেপ ব্লকের প্রতিটি দেশের সঙ্গে পৃথকভাবে বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। তা না হলে, আন্তর্জাতিক বাজারের একটা বড় অংশ ভারতের কাছে অধরা থাকবে, এবং বিভিন্ন দেশের উৎপাদন ও পরিষেবা ভারত সহজে আর পাবে না।

আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে, যেখানে ভারতের আন্তর্জাতিক রফতানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, সেখানে ভারতের পক্ষে অন্য বাজারের লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি।
ফলে ভারতের নজর এখন বৃহৎ উন্নত বাজারের দিকে। এর মধ্যে রয়েছে আমেরিকাও, যারা গত দু দশকের বেশি সময় ধরে পণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রে ভারতীয় বাণিজ্যের অংশীদার।

২০১৭ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনী প্রচার শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য ঘাটতি ও বাণিজ্যের যে সব নিয়মাবলীর ফলে আমেরিকান কর্মীদের সমস্যা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনার নির্দেশ দেন। যেসব দেশ আমেরিকা থেকে যত আমদানি করে, তার চেয়ে বেশি সেখানে রফতানি করে, তার তালিকায় ছিল ভারতও। এর ফলে ২০১৭-১৮ সালে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলারে।

ভারতের জন্য আমেরিকার ঘাটতি চীনের জন্য আমেরিকার ঘাটতির (২০১৯ সালে ৩৪০ বিলিয়ন ডলার) ভগ্নাংশ মাত্র। তা সত্ত্বেও মার্কিন কর্মকর্তারা বারবার ভারতের বাণিজ্যের খারাপ দিকগুলোকে টার্গেট করতে থাকেন। এর মধ্যে ছিল ভারতের চাপানো শুল্কও, যা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অত্যধিক বলে মনে হয়েছিল- এবং যা নিয়ে একাধিকবার স্বয়ং ট্রাম্প নয়া দিল্লির সঙ্গে কথা বলেছিলেন।

আমেরিকানদের সঙ্গে একটি বাণিজ্যের বিষয় গত বছর সামনে আসে, এবং বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল বলেন, দু দেশ চুক্তির বিষয়গুলো প্রায় সমাধান করে ফেলেছে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে গোয়েল বলেন, “আমরা আশাবাদী আমাদের চুক্তির প্রথম বিষয়গুলি খবু শিগগিরই তৈরি হয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের দুপক্ষেরই বিশ্বাস যে ভারত ও আমেরিকা আগামী দিনে বৃহত্তর সম্পর্কে যাবে, এমনকি দুদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দিকেও যেতে পারে।”

তার পর থেকে আর কোনো ঘোষণা হয়নি।

মূল বিষয় নির্ধারণ
২০১৮ সাল থেকে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে, কিন্তু শুল্ক, ভরতুকি, মেধাসত্ত, ডেটা সুরক্ষা, এবং কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের অধিকার নিয়ে মৌলিক মতানৈক্যের জেরে তা শ্লথ হয়ে পড়ে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের দফতরের কাছে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রথম বাধা বলে মনে হয়েছে, দেশের বাইরে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে নাগরিকদের ডেটা পাঠানোর ব্যাপারে কড়াকড়ি। আমেরিকা চায় ভারত পেটেন্টের নিয়মে কড়াকড়ি করুক, এবং ভারতে বিনিয়োগের জন্য মার্কিন সংস্থাগুলি যে সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেগুলো দূর করুক।

হার্লে শুল্ক

ভারত অত্যন্ত বেশি পরিমাণ আমদানি শুল্ক বসায় বলে অভিযোগ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতকে “শুল্ক সম্রাট” বলে একাধিকবার অভিহিত করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি মার্কিন মোটরসাইকেল প্রস্তুতকার্ক সংস্থা হার্লে ডেভিডসনের উদাহরণ দিয়েছেন। ২০১৮ সালে এই বাইকের শুল্ক ভারত ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিলেও, ট্রাম্পের মতে এখনও তা গ্রহণযোগ্য নয়।

মনে করা হয় এই বিশাল ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল ভারতীয় ক্রেতাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবার অন্যতম কারণ হলো এর শুল্ক। কিন্তু ঘটনা হলো হরিয়ানার বাওয়ালের এক কারখানায় ২০১১ সাল থেকে এই বাইকের যন্ত্রাংশ সংযোজনের কাজ চলছে, কিন্তু হার্লে এখনো ভারতীয় বাজারের কোনো বড় অংশ ধরতেই পারেনি। ২০১৭ সালে ৩৭০০-রও কম মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে এক সংস্থা, তারও বেশির ভাগই কমদামি মডেল।

ইস্পাত শিল্পে চাপ

২০১৮ সালে আমেরিকা ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক চারায়। ভারত সরকার দাবি করেছে, এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু তথ্য বলছে ইস্পাত রফতানির ক্ষেত্রে আমেরিকায় ২০১৭-১৮ সালে তারা ৩.৩ শতাংশ রফতানি করলেও, ২০১৮-১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৫ শতাংশ। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভারত আমেরিকার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

জিএসপিতে ছাঁটাই ও তার প্রতিক্রিয়া

২০১৯ সালের জুন মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতে জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) প্রকল্প থেকে ভারতের প্রাপ্ত সুবিধা ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ভারত আগে যে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য নিঃশুল্ক ভাবে সে দেশে রফতানি করতে পারত, তা বন্ধ হয়ে যায়।

আমেরিকার অভিযোগ ছিল, গত কয়েক বছর ধরে তাদের ভারতীয় বাজারে যথাযথভাবে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

আমেরিকার জিএসপি প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিল ভারত। শুল্কহীন সুবিধা থেকে ভারত ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো সুবিধা পেত কয়েক বিলিয়ন ডলার রফতানি করে। বর্তমান বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় ভারত এই সুবিধা ফিরিয়ে দেবার কথা বলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিনরা ভারতকে কয়েকটি নির্দিষ্ট মানের উপর ভিত্তি করে উন্নত দেশ বলে চিহ্নিত করেছে। যদিও এটা স্পষ্ট নয়, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার দরুণ জিএসপি প্রকল্পের সুবিধার উপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে।

বাণিজ্য নিয়ে দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনার মধ্যে জিএসপি তালিকা থেকে অপসারণের ফলে ভারত পাল্টা আমেরিকার আমদানি পণ্যের উপর শুল্ক চাপায়, যার মধ্যে ছিল আমন্ড, তাজা আপেল, এবং ফসফরিক অ্যাসিড। এই পদক্ষেপ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, এবং আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দ্বারস্থ হয়।

ভারত আমেরিকার সবচেয়ে বড় আমন্ড আমদানিকারী, ২০১৮-১৯ সালে তারা ৬১৫.১২ মিলিয়ন ডলারের আমন্ড আমদানি করেছিল।

দুধ, চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি

আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যে তাদের আরও বেশি করে প্রবেশ করতে দিতে হবে। ভারতের আরসেপ ছাড়ার বড় কারণ হলো তাদের দেশীয় কৃষি ও দুগ্ধজাত স্বার্থ রক্ষা করা।

আরএসএসের স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের সহ আহ্বায়ক অশ্বিনী মহাজন বললেন, “সাম্প্রতিক অতীতে ভারত দেশের কৃষক ও ডেয়ারি শিল্পের স্বার্থ রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরসেপে। আমাদের আশা ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তিতেও একই ভূমিকা নেয়া হবে।”

গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বাণিজ্য আলোচনায় ভারতের মার্কিন মেডিক্যাল ডিভাইস ফার্মের প্রবেশের বিষয়টি সামনে এসেছে। বাণিজ্য মন্ত্রী পীযুষ গোয়েল এ বিষয়ে সরকারি আধিকারিক ও বহুজাতিক মেডিক্যাল ডিভাইস ফার্মগুলির মধ্যে আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকেও নিয়ে এসেছিলেন।

ভারত নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে যাতে এই ধরনের দ্রব্যের দাম বেঁধে দেয়া হবে। তবে বোঝা যাচ্ছে না এর মানে সরকার স্টেন্ট ও হাঁটু প্রতিস্থাপকের দাম কমানোর পূর্বতন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে কি না। সরকারের আগের জনস্বার্থে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বহুল পরিমাণে আলোচনা হয়েছিল।

আমদানিকৃত মেডিক্যাল ডিভাইসে স্বাস্থ্য সেস বসানোর কথা ২০২০-২১-এর বাজেটেও ঘোষণা করা হয়েছে, যা আমেরিকার দিক থেকে নেতিবাচক, কারণ এ ধরনের দ্রব্য ভারতে রফতানিকারক প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে তারা।

কিছু সাফল্য, কিছু আশ্বাস
আমেরিকা পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অন্যতম অংশীদার, ভারত অষ্টম বৃহত্তম। বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য থেকে মনে হচ্ছে কোনো চুক্তিই আসন্ন নয়, দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত রসায়ন এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।

২০১৮-১৯ সালে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ১৬.৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, এবং পূর্বতন বাণিজ্য মন্ত্রী সুরেশ প্রভু গত বছর বলেছিলেন উদ্বৃত্ত আরো কমতে পারে, যেহেতু আমেরিকান সংস্থা থেকে বিমান জাতীয় বেশ কিছু পণ্য আমদানি করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা ভারত ও আমেরিকা তাদের গভীরতর আর্থিক অঙ্গীকার বোঝাতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আমেরিকা জিএসপি প্রকল্পের আওতায় ভারতের সুবিধাবলী ফিরিয়ে দিতে পারে, ভারত মোটরসাইকেলের উপর শুল্ক কমাতে পারে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com