পোশাকে আঁকা শহীদ মিনার

0

একুশের পোশাকে সাদা-কালো রঙের প্রাধান্য থাকলেও এখন আর তা এই দুটি রঙের মধ্যে আটকে নেই। সাদা, কালো, লাল, সবুজ, ছাই সব রঙেই সাজছে একুশের পোশাক। কাপড়ের ক্ষেত্রে সুতির প্রাধান্য থাকলেও তাঁত, মসলিন, সিল্ক প্রভৃতির ব্যবহারও বাড়ছে

ভোরের আজান শুনেই ঘুম ভাঙল বিভার। এখনই ওঠার সময়। আলো ফুটেছে কেবল, তবে বের হতে হবে কিছুক্ষণ পরই। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, তৈরি হয়ে প্রভাতফেরিতে বের হবে সে। রুপালি পেড়ে কালো একটা শাড়ি পরেছে বিভা। জমিনে তেমন কাজ নেই তবে আঁচলে শহীদ মিনার আঁকা। শাড়িটা গায়ে জড়াতেই অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মন ভরে উঠল তার। চোখে আলতো করে কাজল টেনে কপালে ছোট্ট টিপ তুলে দিয়ে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে এবার সে একেবারেই তৈরি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে যাওয়ার জন্য।

একুশে ফেব্রুয়ারির সকালটাই যেন কেমন মায়ামাখা। বাতাসের প্রতিটি কণা বিভাকে ছুঁয়ে দিয়ে যেন বলল- ‘হে বাঙালি এ অহংকার তোমার, তুমিই জয়ী!’ পথে যেতে যেতে এখন থেকে একযুগ আগের সময়ে ফিরে গেল সে। চোখের সামনে ভেসে উঠল সে সময়কার একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি। তখন একরঙা কালো ব্লাউজের সঙ্গে কালো পেড়ে সাদা শাড়ি পরে খালি পায়ে হাতে ফুল নিয়ে মেয়েরা প্রভাতফেরিতে অংশ নিত। সাজে-পোশাকে আড়ম্বর থাকত না একেবারেই। সেও তো যেত। অন্যদিকে  ছেলেরা সাদা বা কালো সাদাসিধে পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যেত। যেন পৃথিবীর সমস্ত শুভ্রতা আর পবিত্রতা তাদের ঘিরেই থাকত সে সময়টুকুতে। তবে বর্তমানে বিশেষ দিনগুলোয় নিজেদের পরিধেয় নিয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন হয়েছে মানুষ। আর ফ্যাশন সচেতন মানুষের রুচি-পছন্দ ও বিশেষ দিনগুলোর কথা মাথায় রেখে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোও নিয়ে আসে সময়োপযোগী পোশাক-আশাক।

বিগত অনেকগুলো বছর ধরেই দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাথায় রেখে পোশাকের রঙে ও নকশায় তুলে ধরছে বাংলাদেশের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ‍ও সংস্কৃতি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাশন হাউসগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারায় পোশাকে নকশা করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শহীদ মিনার, বাংলা বর্ণমালা, বাংলা কবি ও কবিতা ইত্যাদি। এভাবেই তারা তাদের পোশাকের নকশার মাধ্যমে গুরুত্ব দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকশা করা পোশাকের মধ্যে নকশিকাঁথা ফোঁড়, ব্লক, অ্যাপলিক, ক্যাটওয়াক, স্ক্রিন, হ্যান্ডপেইন্ট, এমব্রয়ডারির কাজ এবার লক্ষ করা যাচ্ছে।

একুশের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে পোশাকে সাদা-কালো রঙের প্রাধান্য থাকলেও এখন আর তা এই দুটি রঙের মধ্যে আটকে নেই। সাদা, কালো, লাল, সবুজ, ছাই সব রঙেই সাজছে একুশের পোশাক। কাপড়ের ক্ষেত্রে সুতির প্রাধান্য থাকলেও তাঁত, মসলিন, সিল্ক প্রভৃতির ব্যবহারও বাড়ছে।

এবারের মাতৃভাষা দিবসে পোশাক ব্র্যান্ড ‘নিত্য উপহার’ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি, বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দুইশ বছর উপলক্ষে নিত্য উপহার দুটি টি-শার্ট নকশা করেছে। শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগরের নকশায় ‌‘বিদ্যার সাগর’ এবং আমিনুল ইসলাম তুহিনের নকশায় ‌‘দ্বিশত বিদ্যাসাগর’ নামে দুটি টি-শার্ট এসেছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে নিত্য উপহারে এসেছে বাহার রহমানের নকশায় ‌‘বঙ্গভাষা’ ও ‌‘একে বলতে পারো’ নামে আরও দুটি টি-শার্ট। বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের বঙ্গভাষা কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ডিজাইন করা হয়েছে ‌‘বঙ্গভাষা’ টি-শার্টটি। এ টি-শার্টের জমিনে রয়েছে কবিতার পঙক্তি “হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন”।

অন্য টি-শার্টটির জমিনে রয়েছে বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি শহীদ কাদরীর “একে ব’লতে পারো একুশের কবিতা”র পঙক্তি।

নতুন চারটি টি-শার্ট ছাড়াও নিত্য উপহারের অন্যান্য একুশের টি-শার্ট সংগ্রহ করা যাবে নিত্য উপহারের শাহবাগ ও মোহাম্মদপুর বিক্রয়কেন্দ্র থেকে। প্রতিটি বড়দের টি-শার্টের মূল্য ৩৯০ টাকা এবং ছোটদের টি-শার্টের মূল্য ২৫০ টাকা।

এছাড়াও নিত্য উপহারের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকেও অর্ডার করা যাবে টি-শার্টগুলো। টি-শার্ট ছাড়াও একুশে ফেব্রুয়ারির কথা মাথায় রেখে তারা বেশ কিছু শাল নকশা করেছে। কালো, লাল, সাদা, নেভি-ব্লু রঙের এসব শালে ব্যবহার করা হয়েছে বর্ণমালা, সূর্য, বাংলাদেশের মানচিত্রসহ কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। এই শালগুলোর দাম পড়বে এক হাজার টাকা করে।

দেশীয় ফ্যাশন হাউস ‘সাদা কালোর’ শোরুমগুলোয় একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে নকশা করা পোশাক পাওয়া যাবে। তারা সিঙ্গেল কামিজ ও শাড়িতে বর্ণমালার ব্যবহার করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আনা সিঙ্গেল কামিজগুলোর দাম ১০৫০ টাকা থেকে এক হাজার ১৫০ টাকা। অন্যদিকে বর্ণমালা লেখা শাড়ি পাওয়া যাবে ১৫০০ টাকার মধ্যেই।

মহান ভাষা দিবসে ছেলেদের টি-শার্ট ও পাঞ্জাবির নকশায় বিশেষত্ব লক্ষ করা যায়। দেশীয় পোশাক ব্র্যান্ড ডুয়েট ঐতিহ্য তাদের পোশাকে বর্ণমালা ও শহীদ মিনার ব্যবহার করেছে। ডুয়েট ঐতিহ্যের স্বত্বাধিকারী অনুপ কুমার পাল বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আমরা এবার বড়দের ও ছোটদের জন্য টি-শার্ট ও পাঞ্জাবি করেছি। আজিজ সুপার মার্কেটের আউটলেটে এসব টি-শার্টের দাম ছোটদের ক্ষেত্রে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা ও বড়দের জন্য ৩০০ টাকা। আর পাঞ্জাবি ছোটদের জন্য পাওয়া যাবে ৫৫০ থেকে ৮০০ ও বড়দের পাঞ্জাবির দাম ১৪৫০ টাকা।

এছাড়াও আড়ং তাদের একুশে আয়োজনে রেখেছে সাদার ওপর কালো ফ্লোরাল মোটিফের শাড়ি, সাদা-কালো স্ট্রাইপের সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট ইত্যাদি। তারা একুশের পোশাকগুলোয় সাদা, কালো, লাল, সবুজ রঙের ব্যবহার করেছে। এসব সালোয়ার-কামিজের দাম পড়বে ২ হাজার ৭৬২ টাকা থেকে চার হাজার ১২০ টাকা। শাড়ির দাম শুরু হয়েছে ২২০০ টাকা থেকে। এখানে পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে ১২০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে।

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ ‘বিশ্বরঙ’ এবার তাদের পোশাকের সংগ্রহকে সাজিয়েছে শহীদ মিনার ও বর্ণমালা দিয়ে। বরাবরের মতোই ভাষার মাসের বিশেষ রং হিসেবে তারা ব্যবহার করেছে সাদা আর কালো। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে লাল ও ছাইরংও। একুশের আয়োজনে রঙে এবার এসেছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, সিঙ্গেল কামিজ ও ওড়না, সিঙ্গেল ব্লাউজ। ছেলেদের জন্য রয়েছে পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট। পাশাপাশি শিশুদের জন্য তারা নকশা করেছে সালোয়ার-কামিজ, সিঙ্গেল কামিজ, ফ্রক, স্কার্ট টপস সেট, পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট। এছাড়াও পরিবারের সবাই যদি একই নকশার পোশাক পরতে চান তাহলেও রঙে একবার ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। বিশ্বরঙে শাড়ি পাওয়া যাবে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে, পাঞ্জাবির দাম ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা, শিশুদের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে ৭৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে।

দেশীদশের ফ্যাশন হাউস নিপুণ, কে ক্র্যাফট, বিবিয়ানা, দেশাল, বাংলার মেলা, রঙ বাংলাদেশ, নবরূপা, নগরদোলা, সব বয়সীদের জন্য একুশের পোশাক নিয়ে আসে বরাবরেই।। ভাষা দিবসকে সামনে রেখে কে-ক্র্যাফট এনেছে মেয়েদের ফতুয়া, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ছেলেদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবি। এখানে শিশুদের সালোয়ার-কামিজ ১২০০-১৬০০ টাকা, ফ্রক ৬০০-১,২০০ টাকা, কামিজ ৬০০-১২০০ টাকা, স্কার্ট-টপস সেট ১২০০-১,৫০০ টাকা, পাঞ্জাবি ৬০০-১,০০০ টাকা, শার্ট ৫০০-৬৫০ টাকা, টি-শার্ট ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে।

এছাড়া অঞ্জন’স-এর আউটলেটগুলোয় পাওয়া যাবে লাল-সাদা-কালো রঙের মিশেলে সুতির সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, শাড়ি, পাঞ্জাবিসহ শিশু-কিশোরদের জন্য পোশাক। পোশাকের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলা বর্ণমালাসহ বিভিন্ন ডিজাইন মোটিফ। মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে শাড়ি ১৮০০-৩৫০০ টাকা, সালোয়ার-কামিজ ২৫০০-৩০০০ টাকা, ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রে পাঞ্জাবি ৮০০-১২০০ টাকা, শার্ট ৬০০-৮৫০ টাকা, টি-শার্ট  ৪০০-৫০০ টাকা।

দেশী দশের ফ্যাশন হাউজগুলো একটু ঘুরে দেখলে একুশের জন্য নকশা করা পোশাকগুলো পছন্দসই দামের মধ্যেই পেয়ে যেতে পারেন। যেখানে শাড়ির দাম ৮৫০ থেকে চার হাজার টাকা। সালোয়ার-কামিজ ১ হাজার ২৫০ থেকে ৪ হাজার ২৫০, সিঙ্গেল কামিজ ১ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার, সিঙ্গেল ওড়না ৪০০ থেকে ৮০০, ব্লাউজ ২৫০ থেকে ৩৫০, পাঞ্জাবি ১ হাজার থেকে ১৮৫০, টি-শার্ট ৩৫০ থেকে ৪৮০, শার্ট ৭৫০ থেকে ১ হাজার ২০০, উত্তরীয় ২৫০ থেকে ৫০০, শিশুদের শার্ট ৩৫০ থেকে ৫৫০, টি-শার্ট ২৫০ থেকে ৩৮০, পাঞ্জাবি ৪৫০ থেকে ৭৫০, ফ্রক ৪০০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন। 

নামকরা দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো ছাড়াও ফেইসবুকের অনলাইন শাড়ির পেজগুলোও একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে শাড়ি এনেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনগুলোয় শাড়িতে তারা বিশেষ ছাড় রাখে। যারা ঘরে বসেই একুশের পোশাক কিনতে চান তারা কইন্যা, শাড়িজ বিডি, কৃষ্ণকলী, নন্দিনী, ক-তে কাপড়ের ফেইসবুক পেজ ঘুরে দেখতে পারেন। এসব পেজে হাফসিল্ক, সুতি, হ্যান্ডলুম, জামদানি, সিল্ক ও তসরের শাড়ি পাওয়া যায়। এসব শাড়ি ৯৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে। অনলাইনে অর্ডার করলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পণ্য পৌঁছে যাবে ঘরের দুয়ারে।  

বাঙালি ও গোটা বিশ্বের জন্য শ্রদ্ধা ও গৌরবের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। এই দিন পালনে ও নানা আয়োজনে যুক্ত হওয়ার জন্য আমরা যেসব পোশাক পরি সেগুলোয় একুশের চেতনা মিশে রয়েছে সেই শুরু থেকেই। একুশের পোশাকে ব্যবহৃত রং, কাপড় ও নকশা সবটাতেই যেন দীপ্তমান বাংলার ভাষার  ছাপচিত্র ও অমলিন চেতনা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com