কেজরিওয়ালের দিল্লি মিশন : অহঙ্কারের বিপরীতে নম্রতার জয়
বিনয় মানবজীবনের একটি মহৎ গুণ। শব্দটির অর্থ- মিনতি, নম্রতা, শিক্ষা। আর যিনি বিনয় প্রকাশ করেন তাকে বলা হয় বিনয়ী। বিপরীত শব্দ দম্ভ ও দাম্ভিক। যার সহজ অর্থ- গর্ব বা অহঙ্কার। যে গর্ব বা অহঙ্কার করে সে গর্বিত কিংবা অহঙ্কারী। বিনয় মানুষকে অপরাপর সৃষ্টি থেকে আলাদা করে। দুনিয়ার তাবত সফল মানুষের মধ্যেই গুণটির উপস্থিতি লক্ষণীয় মাত্রায় বিদ্যমান দেখা যায়। ব্যক্তিজীবনে যিনি যত বেশি বিনয়ী ও নম্র, তিনি তত বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হন।
বিনয় ও নম্রতা হচ্ছে মানবসংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারাই দয়াময়ের প্রিয় বান্দা, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে’ (সূরা ফুরকান-৬৩)। বিনয়ীকে স্রষ্টা যেমন ভালোবাসেন, তেমনি সব মানুষও ভালোবাসে। বিনয় মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তাই বিনয় অবলম্বন ছাড়া মানুষ নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। বিনয়গুণের জাদুর স্পর্শে মানুষ হয়ে ওঠে সবার থেকে আলাদা। সুতরাং, যেকোনো মূল্যে হোক জীবনের খালি মাঠে বিনয়ের সবুজ গাছ লাগাতে হবে। অন্যথায়, অহঙ্কারের বিষে প্রতারিত হতে হবে। সফল জীবন থেকে হতে হবে বঞ্চিত। যখন জীবনে বিনয়ের আলো না আসে তখন অহঙ্কারের অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যায় মানবতা। অন্তরে নিজের বড়ত্ব সৃষ্টি হয়। আর বড়ত্ব সৃষ্টি হওয়া এমন এক মরণব্যাধি; যা অভ্যন্তরীণ সব রোগের মূল!
বিনয় অবলম্বন করলে বাহ্যিকভাবে যদিও নিজেকে ছোট মনে হয়; কিন্তু তার মর্যাদা আপনা-আপনি উচ্চকিত হতে থাকে। বিনয়ী এবং কোমল আচরণের অধিকারীকে সবাই পছন্দ করে। সব ধর্মে এবং সামাজিক বিবেচনায়ও বিনয়ী মানুষের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিনয় মানুষকে সামাজিকভাবে সম্মানিত করে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অহঙ্কারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না’ (সূরা লুকমান : ১৮)।
আজকাল বিনয়কে অনেকে দুর্বলতা ভাবে। কিন্তু হাল আমলেও সাধারণ মানুষের কাছে বিনয় ও বিনয়ীর কদর আছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিসচেতনদের কাছে বিষয়টি দারুণভাবে ধরা দিয়েছে ভারতের দিল্লি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে। এই নির্বাচনী ফল উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষ দারুণভাবে উপভোগ করেছে। অবাক বিস্ময়ে সবাই দেখল, দিল্লির বাসিন্দারা দাম্ভিকদের পরিহার করে বিনয়ী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রতি আস্থা রেখে তাকে ও তার দল আম আদমি পার্টিকে (আপ) বিপুলভাবে বিজয়ী করেছে। বর্জন করেছে মোদি-অমিত শাহ জুটিকে, মানে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিকে। কেজরিওয়ালের এই বিজয়ের পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই বিজয়ের পেছনে কেজরিওয়ালের বিনয় নিয়ামক শক্তি হিসেবে হাজির ছিল। দিল্লির ভোটারদের যে জিনিসটি প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো- ব্যক্তি কেজরিওয়াল এবং দলগতভাবে আপের বিনয়।
এটি কেজরিওয়ালকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহায়তা করেছে। মূলত কেজরিওয়ালের বিনয়ের কাছে মোদি-অমিত শাহ জুটির দাম্ভিকতার পরাজয় ঘটেছে। তাদের বিভাজনের রাজনীতি ধরাশায়ী হয়েছে। বিজেপি যতই আক্রমণাত্মক হয়েছে, আম আদমি ততই বিনয়ী হয়েছে। ফলে সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতির পাল্লা তাদের দিকেই গড়িয়েছে। বিজেপি জোর দিয়েছিল মেরুকরণের রাজনীতিতে, সে রাজনীতির সামনাসামনি জবাব না দিয়ে আম আদমি পার্টি মেরুকরণের পরিবর্তে উন্নয়ন ও জনকল্যাণের দিকটি প্রধান বিষয় হিসেবে সামনে আনে। সাথে কেজরিওয়াল আর তার দলবল যে পারিবারিক মানুষ; সেটিও ভোটারদের নজর এড়ায়নি। ভোটের পরিসংখ্যান তাই বলে। ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টির মধ্যে ৬২টি আসন জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আম আদমি পার্টি। যদিও ২০১৫ সালের নির্বাচনে দলটি ৬৭টি আসন পেয়েছিল। দিল্লিতে এই মুহূর্তের জনপ্রিয় স্লোগান অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিন্দাবাদ, ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি মুর্দাবাদ। এ স্লোগানের জন্ম দিল্লি নির্বাচনের ভোটের ফল প্রকাশের পর।
তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করায় দিল্লির জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়েও বিনয়াবনত ছিলেন কেজরিওয়াল। তার প্রমাণ মেলে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তার দেয়া বক্তৃতা। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনী প্রচারের সময় রাজনীতি হয়েই থাকে। এবারো হয়েছে। যারা আমার বিরুদ্ধে অসত্য কথা বলেছেন, আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনাদেরও অনুরোধ করছি, আপনারাও সব নেতিবাচক জিনিস ভুলে যান। দিল্লিকে এগিয়ে নিতে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।’
নিজের দুই মেয়াদে দিল্লির ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। অথচ তার জন্য কোনো প্রশংসা নিতে রাজি নন তিনি, ‘সবাই বলছেন, কেজরিওয়াল সব কিছু বিনি পয়সায় দিচ্ছেন। জগতের সব ভালো জিনিসই তো ফ্রি। আমি দিল্লির মানুষকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসাও অমূল্য। আমি কি এখন শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা নেয়া শুরু করব? রোগীদের থেকে ওষুধ ও হাসপাতাল খরচ বাবদ টাকা নেয়া শুরু করব? এটা হবে লজ্জাজনক কাজ।’ তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন এখন শেষ। আপনারা কাকে ভোট দিয়েছেন, সেটি আমার কাছে কোনো বিষয় নয়। আপনারা সবাই এখন আমার পরিবারের সদস্য। আমি বিজেপি-কংগ্রেসের ভোটারদেরও মুখ্যমন্ত্রী।’
ধ্রুপদী রাজনীতির নিয়ম মেনে কেজরিওয়াল এবারের ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। অথচ পাঁচ বছরের অর্ধেকটা তিনি ব্যয় করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করে। আড়াই বছর আগে কেজরিওয়াল সেই যে ঝগড়া থামালেন, দ্বিতীয়বার আর সে পথ মাড়াননি। সচেষ্ট হলেন সাধারণ ও নিম্নবিত্তদের ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবাগুলো পৌঁছে দিতে। বিনা পয়সায় মাসে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ২০ হাজার লিটার পানি দেয়া শুরু করলেন। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে গেলেন মহল্লায় মহল্লায়। সরকারি পরিষেবাকে দালালমুক্ত করে প্রশাসনকে জনমুখী করতে কর্মসূচি হাতে নিলেন। বিনা টিকিটে নারীদের সরকারি বাসে ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। সুরক্ষার জন্য বাসে বাসে নিযুক্ত করলেন রক্ষী। ফলে গণমানুষ আপ-কে নিজেদের দল বলে মনে করতে লাগল। রাজনৈতিক নেতার সাথে জনতার দূরত্ব ঘুচিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টার কসুর করলেন না। দিল্লবাসী মনে করতে লাগল, এটি তাদেরই দল।
নির্বাচনী প্রচারণার মাঝপথে বিজেপি উন্নয়নের রাজনীতি ছেড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে। আর কেজরিওয়ালের নির্বাচনী কৌশল ছিল নাগরিক পরিষেবার সম্প্রসারণ। প্রচারের আগাগোড়া লক্ষ করলে দেখা যাবে, কেজরিওয়ালরা একবারের জন্যও জাতীয় ইস্যু সিএএ, এনআরসি, কাশ্মির অথবা ৩৭০ অনুচ্ছেদ মুখে আনেননি। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া বা শাহিনবাগের আন্দোলনের কথাও উচ্চারণ করেননি। দেশপ্রেম বা দেশদ্রোহ নিয়ে মাথা ঘামাননি। সারাক্ষণ শুধু বলে গেছেন বিদ্যুৎ-পানি-সড়ক-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো নাগরিক পরিষেবার কথা। এর পাল্টা মোদি-শাহ এবং তাদের অনুগামীদের কণ্ঠে বেজেছে উগ্র জাতীয়তাবাদের সুর। ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদ, জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজন দিল্লি নির্বাচনে কাজে আসেনি। মাঠে মার খেয়েছে। অন্য দিকে বিজেপির এই ভরাডুবির অনেক কারণের একটি গত পাঁচ বছরেও কেজরিওয়ালের বিপরীতে দিল্লির কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে না পারা। ক্ষমতা দখলের জন্য প্রচারে বিজেপির নেতারা যেভাবে কথার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন, যেভাবে হিংসা ছড়াতে প্ররোচনা জুগিয়েছেন, ঘৃণার আগুনে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করেছেন, শিক্ষিতজন তাতে বিরক্ত হয়েছেন। এই মানুষেরাই কিন্তু আট মাস আগে লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন করেছিলেন।
তারা দেখেছেন, বিজেপির ‘হাইপার ন্যাশনালিজম’-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেজরিওয়াল ঘরের ছেলের মতো হাসিমুখে পরিষেবার কথা বলছেন। প্রতিপক্ষের কটুকথা গায়ে না মেখে উপেক্ষা করছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে যা বহু দিন ধরে অনুপস্থিত, সেই বিনয় ও শালীনতার প্রত্যাবর্তন দিল্লির আম আদমি সাদরে গ্রহণ করেছে। কেজরিওয়ালের প্রচার ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনৈতিক আবহের বিপরীতে দখিনা বাতাসের ফুরফুরে আমেজ ছড়িয়েছে। এই আবহও বহুকাল দৃশ্যমান ছিল না। এ ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়াল সেই আগের সাদাসিধে জীবনেই অভ্যস্ত। একটুও বদলাননি। ক্ষমতায় থাকার পরও তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। ভারতের রাজনীতিতে এই ভাবমর্যাদা সাম্প্রতিক সময়ে বিরল। এটাও কেজরিওয়ালের জন্য ছিল প্লাস পয়েন্ট। শীতকালে সোয়েটার-মাফলার, গ্রীষ্মে বুশ শার্ট ও চটি জুতায় তিনি যেন পাশের বাড়ির ছেলে, যার বাড়িতে অনায়াসে কড়া নেড়ে ঢুকে পড়া যায়। যাকে ভালোবাসা যায়। ভরসা করা যায়।