এরদোগান এবার দক্ষিণ এশিয়ার মঞ্চে

0

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর তুরস্ক এখন তার অর্থনৈতিক, সামরিক ও ইসলামিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এটা সত্য যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আঙ্কারার অবস্থান এখনো প্রান্তিক পর্যায়ে, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সেটা এমন না-ও থাকতে পারে। যে সব কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের অবস্থান জোড়ালো হতে পারে, সেগুলো হলো: তাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি; চীনের সাথে তাদের বন্ধুত্ব; ভারতের সাথে তাদের তিক্ত সম্পর্ক; এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের অসুখী সম্পর্ক।

সহায়ক শক্তি

দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের এগিয়ে যাওয়ার সহায়ক শক্তি হলো পাকিস্তান। এ অঞ্চলে তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পর্ক হলো পাকিস্তানের সাথে। রিয়াদ তার প্রভাব বলয় অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কোঅপারেশানে (ওআইসি) কাশ্মীর ইস্যুতে জোরালো এবং অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে অনীহা দেখানোর কারণে তাদের ব্যাপারে আশাভঙ্গ হয়েছে ইসলামাবাদের। অন্যদিকে, তুরস্ক এই ইস্যুতে পাকিস্তানকে জোরালো ও অব্যাহত সমর্থন দেয়ার কারণে আঙ্কারা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক একটা ক্রমবর্ধমান উন্নতির দিকে চলেছে।

এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সৌদির অর্থনৈতিক চাপের কারণে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের কুয়ালা লামপুরে ইসলামী দেশগুলোর সম্মেলনে অংশ নিয়ে ওআইসিকে কাশ্মীর ও অন্যান্য মুসলিম ইস্যুতে চাপ দিতে না পারার কারণে আফসোস প্রকাশ করেছেন। সম্মেলনের আয়োজন করেছিল মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক, ইরান, কাতার ও ইন্দোনেশিয়া এতে অংশ নিয়েছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইমরান কুয়ালা লামপুর সফর করে মালয়েশিয়ার নেতা মাহাথির মোহাম্মদের সাথে সম্পর্ক মেরামত করেছেন।

তুরস্ক-পাকিস্তানের সম্পর্কের যে উন্নতি হচ্ছে, তার সর্বশেষ প্রমাণ হলো গত সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের ইসলামাবাদ সফর। শুক্রবার পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দেয়া এক বক্তৃতায় এরদোগান বলেন: “তুরস্ক বিশ্বাস করে যে, দমনমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যুর সমাধান হবে না। এ জন্য ন্যায় বিচার আর শান্তির নীতি লাগবে”। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে প্রকাশ্যেই বলেছে যে কাশ্মীরিদের সংগ্রাম ন্যায্য এবং ওআইসির সকল বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেছে তারা।

পাকিস্তানীরা স্মরণ করেন যে, ২০০৫ সালে আজাদ কাশ্মীরে যখন ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন তুরস্ক ১০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা এবং ৫০ মিলিয়ন ডলারের ত্রাণ সহায়তা, এক মিলিয়ন কম্বল, ৫০,০০০ টন ময়দা এবং ২৫,০০০ টন চিনি দিয়ে সহায়তা করেছিল।

পাক-তুরস্ক সামরিক সম্পর্ক

চীনের পর তুরস্ক পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর তুরস্ক-পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে, পাকিস্তান নৌবাহিনী ১৭,০০০ টনের একটি ফ্লিট ট্যাঙ্কার বহরে যুক্ত করে, যেটা তুরস্কের প্রতিরক্ষা কোম্পানি এসটিএমের সাথে যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জানা গেছে, করাচি শিপইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে নির্মিত এটা এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় জাহাজ।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য চারটি করভেট জাহাজ সরবরাহের জন্য বহু বিলিয়ন ডলারের একটি দরপত্রে জিতে যায় তুরস্ক। এটাকে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আঙ্কারা পাকিস্তানের কাছ থেকে এমএফআই-১৭ সুপার মুশহাক বিমান কিনছে, পাকিস্তানের সাবমেরিনগুলো আপগ্রেড করে দিচ্ছে এবং যৌথভাবে আরেকটি ফ্লিট ট্যাঙ্কার জাহাজ তৈরি করতে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানের কাছে ৩০টি এটাক হেলিকপ্টার বিক্রির জন্য চুক্তি চূড়ান্ত করেছে তুরস্ক।

শুরুতে হোচট খেলেও পরে বাড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ আর তুরস্কের সম্পর্কের সূচনাটা ভালো ছিল না কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তুরস্ক পুরোপুরি পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের আমলে দুই দেশের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হলেও পরে শেখ হাসিনা যখন জামায়াতে ইসলামির নেতাদেরকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার কারণে ফাঁসি দিলেন, তখন তুরস্ক তার বিরোধিতা করায় দুই দেশের সম্পর্কের আবারও অবনতি হয়।

এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ২০১১ সালে ইসলামবাদকে গ্রহণ করে। সে কারণে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী দলকে সমর্থন দেয় তারা। বিচারের ইস্যুতে তুরস্ক বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে তিন মাসের জন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, যেটার কারণে একটা কূটনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল।

আরেকটি সঙ্ঘাতের কারণ হলো বাংলাদেশে তুরস্কের বিরোধী দল গুলেন মুভমেন্টের তৎপরতা। ২০১৬ সালের মে মাসে গুলেন মুভমেন্টকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে তুরস্ক বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ দেয়, যাতে বাংলাদেশে গুলেন মুভমেন্টের ব্যবসায় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাদের কর্মীদের ফেরত পাঠানো হয়।

রোহিঙ্গা ইস্যুর ভূমিকা

তবে, বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমার থেকে বহু লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর তুরস্ক আবারও বাংলাদেশের দৃশ্যপটে আসে। ভারত আর চীন যখন সুস্পষ্টভাবে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছিল, তখন উদারভাবে অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে আঙ্কারা।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সমর্থনে জাতিসংঘ, জি২০, এমআইকেটিএ (মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, এবং অস্ট্রেলিয়া), ওআইসি ও অন্যান্য বহুপাক্ষিক ফোরামে তুরস্ক ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, প্রেসিডেন্ট এরদোগানের স্ত্রী এমিনে এরদোগান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এবং পরিবার ও সামাজিক নীতি বিষয়ক মন্ত্রী ফাতমা বেতুল সায়ান কায়া কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প প্রদর্শন করেন। টার্কিশ কোঅপারেশান অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশান এজেন্সি (টিআইকেএ), ডিজ্যাস্টার অ্যান্ড ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এএফএডি), টার্কিশ রেড ক্রিসেন্ট, ডিরেক্টরেট অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স (ডিয়ানেট), এবং তুরস্কের বিভিন্ন এনজিও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় দরিদ্র মানুষের জন্য ক্যাম্প, হাসপাতাল, স্কুল, এতিমখানা, এবং ফ্যাসিলিটি নির্মাণ করে দিয়েছে।

তুরস্ক-শ্রীলংকা সম্পর্ক

তুরস্ক শ্রীলংকারও দ্বারস্থ হচ্ছে কারণ ভারত মহাসাগরে কৌশলগত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীলংকা যেখানে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সুবিধা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমাদের থেকে কলম্বো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং তাদের সাথে চীন ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের বিষয়গুলোকে কাজে লাগাতে চায় তুরস্ক।

নয়াদিল্লী-ভিত্তিক তুরস্কের রাষ্ট্রদূত দেমেত সেকেরকিয়োগলুর সাম্প্রতিক কলম্বো সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা তুরস্ককে অনুরোধ করেছেন যাতে তারা শ্রীলংকার পর্যটন খাতের উন্নয়নে সহায়তা করে কারণ টার্কিশ এয়ারলাইন্সের বিমান প্রতিদিনই শ্রীলংকায় যাতায়াত করছে। দুই পক্ষ প্রতিরক্ষা খাত নিয়েও আলোচনা করেন এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের ব্যাপারেও সম্মত হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সেকেরকিয়োগলু রাজাপাকসাকে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান আবার শ্রীলংকা সফরে আগ্রহী। ২০০৫ সাল সর্বশেষ শ্রীলংকা সফর করেন এরদোগান। ২০০৪ সালের এশিয়ান সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সফরের অংশ হিসেবে তখন শ্রীলংকা গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় সুনামি-আক্রান্ত দক্ষিণ শ্রীলংকায় ৪৫০টি বাড়ির সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রাম নির্মাণ করে দিয়েছিল তুরস্ক।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com