বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার দাবি করেছেন ভূক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী

0

“বিশ্বজিৎ বারবার বলেছিল, ‘আমি হিন্দু, শিবির না। আমাকে ছেড়ে দেন।’ অনেকবার বলা সত্ত্বেও তাকে ছাড়া হয়নি। এমনকি বিশ্বজিৎ বলেছিল, আমি হিন্দু, দরকার পড়লে প্যান্ট খুলে দেখেন, তারপরও সে রক্ষা পায়নি। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বজিৎকে হত্যা করা”, কথাগুলো ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন এক যুগ আগে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম এবং বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের শিকার বিশ্বজিৎ দাসের বাবা অনন্ত দাস।

সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ১২ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিচারের নামে নাটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ বিশ্বজিৎ দাসের পরিবারের। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার দাবি করেছেন ভূক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী।

বিশ্বজিৎ দাসের পরিবার সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের মশুরা গ্রামে ১৯৮৮ সালের ২৮ আগস্ট বিশ্বজিৎ দাসের জন্ম। রাজধানী ঢাকার শাখারীপট্টি বাজারে টেইলার্সের (দর্জি) দোকানের কর্মী ছিল বিশ্বজিৎ। ২০১২ সালের ৯ ই ডিসেম্বর ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলন চলমান ছিল। সরকার বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে আইনজীবীরা মিছিল বের করলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আইনজীবীদের ধাওয়া করলে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসও ধাওয়া খায়। ধাওয়া খেয়ে বিশ্বজিৎ প্রথমে একটি ডেন্টাল ক্লিনিকে আশ্রয় নিলে সেখানে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার উপর হামলা চালায়। প্রাণ ভয়ে বিশ্বজিৎ অন্য ভবনে আশ্রয় নিলে সেখানেও বিশ্বজিৎ দাসের উপর রড ও চাপাতি দিয়ে হামলা চালানো হয়। এসময় রক্তাক্ত বিশ্বজিৎ প্রাণ বাঁচাতে আবার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা অব্যাহত রাখে।

এক পর্যায়ে বিশ্বজিৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে স্থানীয়রা তাকে হাসপাতাল নেওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। এসময় প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে বিশ্বজিৎআবারও দৌঁড় দেয় কিন্তু শাঁখারি বাজারের একটি গলিতে গিয়ে ঢলে পড়ে সে। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ মামলা দায়ের করে আসামীদের মৃত্যুদণ্ডসহ যাবজ্জীবন সাজা দিলেও রায় বাস্তবায়ন করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার দাবি করেছেন তার পরিবার ও এলাকাবাসী।

বিশ্বজিৎ দাসের মা কল্পনা রাণী বলেন, “বিশ্বজিৎ আমার ছোট ছেলে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, বিশ্বজিৎকে আমি বিয়ে করাব। আমার নাতি-পুতি হবে। আমার ছেলেরে কেমনে কুপিয়ে হত্যা করে মারল? আমি বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার চাই।”

বিশ্বজিৎ দাসের বাবা অনন্ত দাস বলেন, “সেদিন ছিল অবরোধ। অবরোধে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল। বিশ্বজিৎ শাঁখারী বাজারের বাসা থেকে দোকানের দিকে রওনা করছিল। বিশ্বজিৎ ভীতু প্রকৃতির ছিল। বোমার শব্দে ভয় পেয়ে বিশ্বজিৎ দৌড় দিয়েছিল। পথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানে জগন্নাথ কলেজের নেতাকর্মীরা তার উপর হামলা করে। বিশ্বজিৎ বারবার বলতেছিল, আমি হিন্দু, আমার দোকান আছে। কিন্তু তারা কোনো কথা শোনেনি। একটি দোকানে আশ্রয় নিয়েছিল সেখানেও হামলা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এক যুগ পেরিয়ে গেল, এখনো বিচার পাইলাম না। বিচারে রায় হয়েছে, কিন্তু কার্যকর হয়নি। বর্তমান সরকারের কাছে, আমার দাবি বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার যেন তারা করেন।”

অনন্ত দাস আরো বলেন, “তৎকালীন সময়ে দেশের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও কবি সাহিত্যিকরা বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি করেছিল। এরমধ্যে একজন ফরহাদ মজহার। আমি ফরহাদ মজহারসহ অন্যদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ফরহাদ মজহার সাহেব, আপনি তখন বলেছিলেন- বিশ্বজিতের রক্তে ভেসে যাচ্ছে, বাংলাদেশ। আজকেও যদি আপনি ও আপনরা বলতেন তাহলে মনে হয় ভালো হতো। আপনার স্মরণে আছে কিনা জানি না, আজ থেকে ১২ বছর আগে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়েছিল। আমি পিতা হয়ে কী ছেলে হত্যার বিচার পাবো না? আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি বিশ্বজিৎ হত্যার বিষয়ে কথা বলুন। ফরহাদ মজহারের মতো দেশের বুদ্ধিজীবীসহ সিনিয়র নাগরিকদেরও আমি বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার করার জন্য কথা বলতে অনুরোধ করছি।”

তিনি আরো বলেন, বিশ্বজিৎ বারবার বলছিল, আমি শিবির না, আমাকে ছেড়ে দেন। অনেকবার বলা সত্ত্বেও তারা শোনেনি। আমার বাবা বারবার বলেছিল, আমি হিন্দু, দরকার পড়লে প্যান্ট খুলে দেখেন। তারপরও ছাড়েনি। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বজিৎকে হত্যা করা। যদি হত্যাই উদ্দেশ্য না থাকত, তাহলে বারবার যে বলছিল, শিবির না, হিন্দু। কথাটি তারা শুনত। আজ বারো বছর হয়ে গেছে, কোনো বিচার হলো না। আমি এক যুগ পর এসেও বিচার চাই, বিচার পাইলে আমি মরলেও বাবা হিসেবে আমার আত্মা শান্তি পাবে।”

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com