দিল্লিতে এমন পরাজয় কি অবধারিতই ছিল?
চলতি সপ্তাহে দিল্লি রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপির ভূমিধস পরাজয়ের প্রতীকি ও স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। রাজ্য বিধান সভাগুলোতে ভারতের ক্ষমতাসীন গেরুয়া দলটির এটি ছিল টানা ষষ্ট পরাজয়।
যে দিল্লিতে অবস্থিত ভারতীয় পার্লামেন্টে বিজেপির প্রাধান্য রয়েছে, সেখানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও মন্ত্রী ও রাজ্য পর্যায়ের নেতাদের বিশাল বহরও তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। আবার তাদের সবচেয়ে প্রবল অস্ত্র তথা উদ্ধত সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও এমনটা ঘটেছে।
দিল্লিতে সাম্প্রদায়িকতা সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যানে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারত ধর্মীয় চরমপন্থাবাদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির রাজনীতির প্রতি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। দিল্লির ভোটাররা গেরুয়া ব্রিগেডকে শাস্তি দিয়েছে ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে পণ্য ও পরিষেবা প্রদান না করার জন্য।
দিল্লি হলো ভারতের প্রতিকৃতি। কারণ এটি কার্যত কারোর নগরী নয়, আবার সবারই নগরী। সময়ের পরিক্রমায় এর সারা ভারতের লোকজন ক্রমাগত বেশি বেশি করে মিলেমিশে গেছে ক্ষমতা ও অর্থের সন্ধানে।
ফলে কোনো কোনোভাবে বলা যায়, দিল্লিতে বিজেপির ব্যাপকভিত্তিক পরাজয় (তারা ৭০টির মধ্যে আসন পেয়েছে মাত্র ৮টি, বাকিগুলো পেয়েছে আপ) এই প্রমাণ দেয় যে দলটি তার চরম অবস্থানে পৌঁছে গেছে এবং এখন পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অনেক পণ্ডিত এই যুক্তি দিতে পারেন যে ভারতীয় ভোটারেরা স্মার্ট এবং দিল্লির ভোটারেরা আরো স্মার্ট। তারা পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজেপিকে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছে। ওই নির্বাচনে আপ পেয়েছিল মাত্র একটি আসন (সেটিও দিল্লিতে নয়, পাঞ্জাবে)। কিন্তু রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে তারা বিজেপিকে শাস্তি দিয়েছে এবং সরকারি স্কুলের মানোন্নয়ন, স্কুল ফি হ্রাস করা, সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা (এবং তা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায়), সরকারি হাসপাতালের মান বাড়ানো ইত্যাদি কাজে দারুণ দক্ষতার জন্য কেজরিওয়ালকে পুরস্কৃত করেছে।
সাবেক সরকারি সহকারী কর কমিশনার ও ভারতের বিখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গ্রাজুয়েট কেজরিওয়াল অনেক ইস্যুতে মোদিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তার বার্তাগুলো কঠিন হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল : কিভাবে কথা কম বলে কাজ বেশি করতে হয় তা আমাদের কাছ থেকে শিখুন। আমাদের জনগণকে বিভক্ত না করে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করুন। আপনি হয়তো দুর্নীতির তথ্য উদঘাটনের জন্য কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বিরোধী রাজনীতিবিদদের ভীত প্রদর্শন করতে পারেন, কিন্তু আমাকে ভয় দেখাতে পারবেন না, কারণ আমি দুর্নীতিবাজ নই এবং আমি জানি এসব সংস্থা কিভাবে কাজ করে।
এসব স্লোগানে কাজ হয়েছে এবং মোদি ও অমিত শাহের এসবের কোনো জবাব ছিল না। তারা যা করতে পারত তা হলো আপের উপদেশগুলোকে বিদ্রুপ করা এবং তার সমর্থকদের পাকিস্তানি বা সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করতে।
রাজ্য পর্যায়ে বিজেপির নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। সবাই নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের ছায়া বাস করছে। আর এটিই গেরুয়া ব্রিগেডকে আক্রান্ত করতে শুরু করেছে, ঠিক যেমন কংগ্রেসের ‘হাই কমান্ড কালচারের’ ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
ভারতের মতো বিশাল দেশে নানা পরিচিতি জীবনের বাস্তবতা এবং ফেডারেলবাদই হতে পারে মোদির কেন্দ্রীভূতকরণের মোদি-শাহ জুটির পদক্ষেপের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক বিকল্প। মোদি-শাহের কর্মপদ্ধতি পার্লামেন্টে কাজ করতে পারে, কিন্তু রাজ্য বিধান সভায় নয়।
বিজেপি ও এর মিত্ররা মাত্র অর্ধেক ভারতীয় রাজ্য ও এক-তৃতীয়াংশ ইউনিয়ন ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। মমতা ব্যানার্জি খুবই স্পষ্টভাবে বলেছেন, বিজেপি রাজ্যহীন হয়ে পড়ছে। কংগ্রেস (তারা ২০১৫ সালের মতো এবারো একটি আসনও লাভ করতে পারেনি) মৃত্যুর দিকে যেতে থাকায় ভারত নিয়ন্ত্রণের লড়াই ক্রমবর্ধমান হারে মোড় নিচ্ছে বিজেপি ও শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে।
আগের কলামে আমি অত্যাসন্ন ‘ফেডারেল সঙ্কটের’ ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধেক ভারতীয় রাজ্য নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে বিজেপিকে বাধ্য হয়েই দেশব্যাপী জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বাস্তবায়নের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হয়েছে। উল্লেখ্য, এনআরসির ফলে গত বছর আসামের প্রায় ২০ লাখ লোক তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
দিল্লিতে এটি কেজরিওয়ালের টানা তৃতীয় জয়। এ ধরনের কৃতিত্ব একমাত্র ছিল কংগ্রেসের সাবেক দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের। ভারতের রাজধানীকে আধুনিকায়নের কৃতিত্ব দেয়া হয় তাকেই। কেজরিওয়াল ২০১৫ সালে দিল্লিতে বিজেপিকে পরাজিত করেন ৬৭-৩-এ। এটাও ছিল অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ এর মাত্র এক বছর আগে ২০১৪ সালে মোদি বিপুল জয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
বিশ্লেষকেরা এবার মনে করেন যে শাহিনবাগে মুসলিম নারী বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করা, জামিয়া মিল্লিয়া ও জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাসহ বিজেপির বিভেদসূচক প্রচারণা দলটিকে কিছুটা সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে সিঙ্গেল ডিজিটেই রাখতে সক্ষম হয়েছেন কেজরিওয়াল। বিজেপির একমাত্র স্বান্ত্বনা হলো এই যে তাদের ভোটের হিস্যা ৩২ থেকে ৩৮-এ দাঁড়িয়েছে। তবে আসনের দিক থেকে বেড়েছে মাত্র ৫টি।
২০১৪ সাল থেকে মোদি ও শাহের অধীনে নির্বাচনী সাফল্যের জন্য বিজেপি মাত্র অভিন্ন ফরমুলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। সেটি হলো হিন্দুত্ববাদ ও পাকিস্তানবিরোধী বাগাড়ম্বড়তা, মোদির বক্তৃতা দক্ষতাকে কাজে লাগানো, বিরোধী দলগুলোকে দেশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা, ভিআইপি নেতাদের দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া, সামাজিক মিডিয়ার ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো। এসব কিছিু দলের কর্মীদের উজ্জীবিত করে, সাংগঠনিক গতিশীলতা নিশ্চিত করে।
অনেক রাজ্যে তা কাজ করেছে। কিন্তু এখন তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেজরিওয়ালের মতো লোকদের বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র কোনোই কাজে আসছে না।
কেজরিওয়ালের ঘনিষ্ঠ মিত্র পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জিও ২০২১ সালের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনে একই পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন।
মমতা বলে দিয়েছেন, বিজেপি শেষ হয়ে গেছে, জাদু খূব বেশি দিন থাকে না, কাজ করে না। তিনি কলকাতার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সিএএ হবে না, এনআরসি হবে না, এনপিআর হবে না, ভারতীয় জনগণকে বিভক্ত করা যাবে না। প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের, প্রয়োজন উন্নয়নমূলক কাজের, প্রয়োজন জনগণের পরিচর্যা করা। কেজরিওয়াল এসব কাজ করেই বিজেপিকে ধ্বংস করেছেন।
দিল্লিতে বিজেপি কোনো স্থানীয় নেতাকে উপস্থাপন করতে পারেনি। বেশির ভাগ রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনেই এমনটা হচ্ছে। ২০১৫ সালে দিল্লিতে কিরন বেদীকে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপনের পর তারা আর কখনো কেজরিওয়ালের মুখোমুখি হওয়ার জন্য কারো নাম ঘোষণা করেনি। মনোজ তিওয়ারি আসলে কেজরিওয়ালের কাছাকাছিও যেতে পারার ক্ষমতা রাখেন না।
মজার ব্যাপার হলো বিজেপির বিষেই বিজেপিকে হত্যা করেছেন কেজরিওয়াল। রাহুল গান্ধী ব্যক্তিগত অবস্থান নিয়ে মাইম, কৌতুক, হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডস ইত্যাদি দিয়ে তাকে শেষ করে দিয়েছে বিজেপি। কেজরিওয়ালের আইটি সেল ঠিক একইভাবে মনোজ তেওয়ারিকে ডুবিয়ে দিয়েছে। তিনি মাথাই তুলতে পারেননি।
বিহারে মোদি যখন নিতিশ কুমারের ডিএনএ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন নিতিশ ডিএনএর নমুনা মোদির বাড়ির ঠিকানায় পাঠাতে শুরু করেছিলেন। তা দেখে এক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন, সবাই খেলা শিখে ফেলছে।
বিজেপির পরবর্তী বড় লড়াই হবে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে। এখানেও বিজেপিকে রাজপথের লড়াকু সৈনিক মমতা ব্যানার্জির সামনে পড়তে হবে। মমতার আছে বাঙালির গর্ব আর পল্লী উন্নয়নের বিপুল রেকর্ড। মমতা যদি তার রাজ্যে বড় কিছু শিল্প বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারেন এবং বাংলা পক্ষের মতো গ্রুপগুলোর উত্থান নিশ্চিত করা যায়, তবে এখানেও ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করা বিজেপির জন্য খুবই কঠিন হয়ে যাবে।
বিজেপির সামনে মাত্র একটি পথই খোলা আছে, তা হলো অন্তর্ভুক্তমূলক রাজনীতির দিকে যাওয়া। কিন্তু সেটি তো বিজেপির ডিএনএতে নেই!