আওয়ামী লীগের আমলে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার: ড. ইফতেখারুজ্জামান
দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে সহায়ক সংস্থা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও একই কাজে ব্যবহার হয়েছে। দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারায় ঠেলে দেওয়ার পেছনে মূল দায়ী হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল শনিবার এক সেমিনারে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তাঁর মতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ, পাচারের সুযোগ বন্ধ করা ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। মৌলিক সংস্কার ছাড়া শুধু কয়েকজন ব্যক্তির পরিবর্তনে এর সংস্কার হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক দল এবং আমলাতন্ত্র সঠিক পথে আনা না যায়।
‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উপায়’ শিরোনামের সেমিনার আয়োজন করে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফ। রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে এ সেমিনার আয়োজনে সহযোগিতা করে ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ নাঈম চৌধুরী, সাংবাদিক মীর সাদি, ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
গ্রিনওয়াচ ঢাকার সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ থেকে মোট কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে, ১৭ বছরে ১০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। তবে পাচারের প্রকৃত পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে। বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, বছরে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। পাচারের প্রধান দুই মাধ্যম ব্যাংকিং এবং আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য। এর বাইরে বিদেশি নাগরিকদের আয়করের মাধ্যমে, ভিসা কিংবা ওয়ার্ক পারমিট, হুন্ডি, স্বাস্থ্যসেবা ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে পাচার হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসার ত্রিমুখী আঁতাত মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে দলীয়করণের চর্চা হয়েছে। গত ১৫ বছরে যার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে। এতে আমলাতন্ত্রকে কর্তৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি, আর কাজ বাস্তবায়ন করতে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন এজেন্সিকে। ফলে এসব জায়গায় কতটুকু পরিবর্তন আনা যাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এত প্রাণ এবং ত্যাগের বিনিময়ের অর্জনকে টেকসই করতে হবে।
পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে সব দেশে এ ধরনের অর্থ গেছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। কারণ, ওইসব দেশে পাচারের অর্থ পেতে সংগঠিত সিন্ডিকেট রয়েছে। এ কারণে কয়েকটি দেশে একজন সাবেক মন্ত্রীর তিন শতাধিক বাড়ি থাকার খবর পাওয়া গেছে। পাচারের অর্থ ফেরত আনা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। সিঙ্গাপুর থেকে ৩০ লাখ ডলার ফেরত আনার উদাহরণ আছে।
টিআইবিপ্রধান বলেন, অর্থ পাচার রোধে দুদক, সিআইডি, এনবিআর, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং বিএফআইইউর কাছে পরিষ্কার পথনকশা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শুধু ব্যক্তি পরিবর্তন না করে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু আইনেরও প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধে সাধারণ মানুষের সক্রিয় নজরদারি প্রয়োজন। দুদকের স্বাধীনভাবে কাজ করা প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সব সরকারই দুদককে করায়ত্ত করে থাকে। এ কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুদক যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তাদের বিষয়ে তথ্য আগেও দুদক জানত। অর্থাৎ রাজনীতি সঠিক না হলে দুদকের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। দুদকের দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী সংস্কারের জন্য কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়। অনুমান করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার পাচার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আইএমএফের ঋণ নিয়ে কথা বলা উচিত। আন্তর্জাতিক আইনে ঋণ নেওয়া এবং দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়-দায়িত্ব রয়েছে। আইএমএফ জেনেশুনেই একটা অবৈধ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ঋণ দিয়েছে। তারা জানে, এ অর্থ চুরি হয়। জনগণের কাজে আসে না। ওই অর্থে কেনা গোলা-বারুদ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। ইকুয়েডর, কিউবার মতো কয়েকটি দেশে গত ২০ বছরে এ ধরনের অর্থ ফেরত না দেওয়ার উদাহরণ আছে। পুরো অর্থ রেয়াত পাওয়া না গেলেও অন্তত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রেয়াত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। গত সরকারের সময়ে বিভিন্ন উৎস থেকে যত ঋণ নেওয়া হয়েছে এবং ব্যয় করা হয়েছে, সবগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানান তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভাবশালীরা পাচার করা অর্থ হজম করে ফেললে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো উদাহরণ হবে না। এ জন্য পাচারকারীদের চিহ্নিত করতে হবে, বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাচারের বিষয়টি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। অর্থনীতিবিদ নাঈম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক যেখানে হাইজ্যাক হয়, সেখানে বিনিয়োগ আকর্ষণ কীভাবে সম্ভব।