স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকলেই কি তালাক হয়ে যায়?
অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী দীর্ঘদিন স্ত্রীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ বা খোঁজ-খবর রাখে না। স্ত্রী-সন্তান রেখে নিরুদ্দেশ। এভাবে বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়। এদিকে স্ত্রীও স্বামীর সংসার ফেলে কোথাও যায়নি। স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে।
প্রশ্ন হলো- স্বামী-স্ত্রী যদি দীর্ঘদিন আলাদা থাকে তবে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক কি ঠিক থাকে? অনেককে বলতে শোনা যায়, স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘদিন আলাদা থাকলে নাকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে? এভাবে কি তালাক সংঘটিত হয়?
না, স্বামী-স্ত্রী যদি দীর্ঘ সময় আলাদা থাকে কিংবা দেখা-সাক্ষাৎ না হয় তবে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটবে না। যদি কেউ কাউকে তালাক না দেয় কিংবা তালাকের অনুমতি না দেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে এ কথা সঠিক নয় যে, ‘নির্দিষ্ট সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাস না করলে বিয়ে টিকে না বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাক হয়ে যায়। বরং স্বামী যদি তালাক না দেয় কিংবা এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে স্ত্রী কোর্টের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ না ঘটায় তবে আপনা-আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাক হবে না। যদিও তারা উভয়ে পাঁচ, ১০ কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে আলাদা থাকে।‘
যেহেতু দীর্ঘ সময় আলাদা থাকার কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে না, তাই যেসব স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘ সময় আলাদা থাকার পর কিংবা কোনো স্বামী দীর্ঘ সময় নিরুদ্দেশ থাকার পর আবার স্ত্রীর কাছে ফিরে আসে তাদের সংসার করায় কোনো দোষ নেই। আবার দীর্ঘ সময় পর ঘর-সংসার করার জন্য নতুন করে কোনো আনুষ্ঠানিকতারও প্রয়োজন নেই।
তালাক পতিত হওয়া সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত স্কলার শায়খ বিন বাযরাহমাতুল্লাহি আলাইহি এক ফতোয়ায় বলেছেন-
‘একজন মহিলা তালাকপ্রাপ্ত বলে তখনই পরিগণিত হবে যখন তাকে তার স্বামী সুস্থ মস্তিষ্কে স্বেচ্ছায় তালাক প্রদান করে এবং তালাক নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ না থাকে। যেমন- পাগল বা মাতাল হওয়া ইত্যাদি। স্বামী তালাক দেয়ার সময় স্ত্রী (ওই নারী) ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র ছিল কিন্তু স্বামী এ অবস্থায় তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেনি। অথবা মহিলাটি গর্ভবতী ছিল অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে ঋতুস্রাব বন্ধ ছিল।’
মনে রাখা জরুরি
সুন্দর ও উত্তম দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করা সম্পর্কে কুরআন-সুন্নায় নির্দেশ ও নসিহত রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সুন্দর ও উত্তম সংসার জীবন যাপন করাকে আল্লাহ তাআলা আবশ্যক করেছেন। এ সুসম্পর্ক যার দ্বারা ব্যাহত হবে, তাকে কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
স্বামী-স্ত্রী কীভাবে সুন্দর ও উত্তমভাবে জীবনযাপন করবে, সে সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা উঠে এসেছে কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘নারীদের সাঙ্গে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতপর যদি তাদের অপছন্দ কর, তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৯)
হাদিসে পাকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন-
‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। কেননা তোমাদের বাম পাঁজরের হাড় থেকে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড় সবচেয়ে বাঁকা হয়। যদি তুমি তা সোজা করতে চেষ্টা কর তাহলে তা ভেঙে যাবে। আর যদি সেভাবেই ছেড়ে দাও তাহলে সর্বদা বাঁকাই থাকবে। সুতরাং তাদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করতে থাক।’ (বুখারি)
অন্য হাদিসে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ কোনো মুমিন নারীকে ঘৃণা ও অপছন্দ করবে না। যদি সে তার কোনো স্বভাবকে অপছন্দও করে তবে সে তার অন্য একটি স্বভাবকে পছন্দ করবে।’ (মুসলিম)
সুতরাং কোনো স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, তার হক নষ্ট করে, ভরণ-পোষণ না দেয় বা স্ত্রী-সন্তানকে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় বা পালিয়ে বেড়ায় তাহলে অবশ্যই ওই স্বামী আল্লাহর কাছে যেমন গোনাহগার হবে। রাষ্ট্রীয় আইনেও সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে।
স্ত্রীর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। স্বামীর যথাযথ হক আদায় না করে, সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন না করে পালিয়ে বেড়ানোয় যেমন গোনাহ রয়েছে আবার রাষ্ট্রীয় আইনেও সে অপরাধী। তাই দীর্ঘ সময় কাউকে কষ্ট দিতে এ আচরণ কারো থেকেই গ্রহণযোগ্য ও শোভনীয় নয়।
সুতরাং স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কেউ দীর্ঘদিন আলাদা থাকার পর তালাক না দিলে এমনিতে যেমন বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে না আবার একসঙ্গে ঘর সংসার করতে গেলেও নতুন করে কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই।
একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, স্বামী যদি স্ত্রীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তবে প্রথমে তার (স্ত্রীর) কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে নেবে।
আর যদি স্ত্রী তার স্বামীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, কষ্ট দেয়। তবে স্বামীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে পরস্পরের মনোমালিন্য দূর করা স্ত্রীর জন্য আবশ্যক। তাতেই দাম্পত্য জীবনে ফিরে আসবে আল্লাহর রহমত ও শান্তি।