ভাইরাস নিয়ে রাজনীতি
কোনো রোগের প্রাদুর্ভাবকে গণতান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করা উচিত। এগুলো নোংরা, প্রাণঘাতী ও সহজেই দেখা যায়। বয়স, জাতীয়তা, ধর্ম, জেন্ডার বা জাতি কোনো কিছুই এখানে কোনো ব্যাপার নয়, আপনি শিকার হতে পারে এর।
সবাই এর শিকার হতে পারে, কাজেই এটি একটি সার্বজনীন হুমকি। এ কারণে একে আমাদের অভিন্নভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে, তখন বিশ্বজুড়ে অন্তত ৩০ হাজার লোক নোবেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছে বলে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। আর এই রোগে মারা গেছে ৬৩০ জন। এই লেখাটি যখন পাঠকের হাতে পড়বে, তখন আক্রান্ত্রের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা উভয়টিই অনেকে বেশি হবে বলে দেখা যাবে। চীনের উহানের একটি জনাকীর্ণ বাজারে অজ্ঞাত একটি আক্রান্ত প্রাণি থেকে যে রোগটি ছড়িয়েছে, সেটি এখন এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আমেরিকার ২৩টি দেশে পৌঁছে গেছে।
জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের রোগতত্ত্ববিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাস্টিন লেসলার বলেন, এ ধরনের মহামারীর সাথে পুরো মানবজাতিকে সম্পর্কিত করতে সামান্য কয়েকটি লিঙ্কের প্রয়োজন হয়। আবার ১৫তম শতকে স্প্যানিয়ার্ডরা আমেরিকা থেকে গুটি বসন্ত নিয়ে আসার পর থেকে লোকজন আর বিচ্ছিন্ন নয়।
কলম্বিয়াসের আগে সভ্যতাগুলোর উত্থঅন ও সমৃদ্ধ হতো সম্পূর্ণভঅবে অন্যদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই। অর্ধ সহস্ত্র বছরের মধ্যে গুটি বসন্ত বা বর্তমানের করোনা ভাইরাস- যাই হোক না কেন, সেগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে কেবল আক্রান্ত মানুষের মধ্যে। ২১ শতকে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি হয়েছে তা হলো এই যে মানুষ এত বেশি পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে যে এখন আর রোগ বিস্তৃত হতে তেমন সময় লাগে না। ২০১৯ সালে প্রায় ৪০ মিলিয়ন লোক বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক বিমান ব্যহার করেছে। এতে আরোহন করেছে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন যাত্রী। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ভাইরাসের জীবাণু ভয়াবহ মাত্রায় বিস্তার লাভ করতে পারে।
ইমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সংক্রমণ রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডদ জে ভাকে বলেন, বিমান ভ্রমণে এই রোগটি আরো ভয়াবহভাবে বিস্তৃত হতে পারে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা ভাবুন। এটা প্রথম শনাক্ত হয়েছিল মেক্সিকোতে। তারপর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সেটি যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এর কারণ ছিল বিমান ভ্রমণ। ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১০ সালের এপ্র্রিল পর্যন্ত এই রোগে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ৬০.৮ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত হয়েছিল বলে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে। এই রোগে কোয়ার্টার মিলিয়ন লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, মারা গিয়েছিল ১২ হাজার। সিডিসির মতে, আরো নানা ভাইরাসের কারণে দেড় থেকে পৌণে ছয় লাখ লোক মারা গেছে।
মহামারী ও বৈষম্য
এটা ঠিক যে বিমান ভ্রমণের মাধ্যমেই রোগটিটি সবচেয় দ্রুত ছড়ায়, তাই বলে এটিই একমাত্র মাধ্যম নয়। সেই ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর কথা বলা যাক। তখন তো বিমান ছিল না। তখন ছিল জাহাজ আর রেললাইন। বিমান থাকলেও তা ছিল দুই একটি। অথচ এই রোগে মারা গিয়েছিল দুই থেকে ১০ কোটি লোক। আবার ১৮০০-এর দশকে রেললাইন ছিল না, বিমান তো ছিলই না। তখনো কিন্তু বিপুলসংখ্যক লোক মারা গিয়েছিল।
বাস্তবে সংক্রমণশীল রোগের সহজে সংক্রমণের একটি ধারা থাকে। আর তা মানুষের মধ্যে বেশ দ্রুত আঘাত হানে।
এই ভাইরাসের নামকরণ নিয়েও থাকে রাজনীতি। নোবেল করোনা ভাইরাসকে বলা হচ্ছে উহান করোনা ভাইরাস বলে। কারণ এটি উহান নগরীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। ইবোলা ভাইরাসের ওই নাম হওয়ার কারণ এটি কঙ্গোর ইবোলা নদী থেকে শনাক্ত হয়েছে। মার্স ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে সৌদি আরব। একারণে এর নাম হয় মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম। কিন্তু এইডস ভাইরাস নিউ ইয়র্ক সিটিতে আবির্ভুত হলেও একে কিন্তু এনওয়াসি-১ ভাইরাস বলা হয়নি। আবার এমআরএসএ আবিষ্কৃত হয়েছে বোস্টনে। কিন্তু একে বোস্টন প্লাগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে আরেক ধরনের নোংরা খেলা দেখা যায়। ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসের সময় বলা হলো, গিনির লোকজন বাদুরের মাংস খায় এবং তা থেকে এই রোগের বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু পরে জানা গেল এই গালগল্পের ভিত্তি। এক দুর্ভাগা মেয়ে বাদুরের ফেলে দেয়া দূষিত খাবার খেয়ে ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। আর উহানের বাজারে মানুষের খাদ্য হিসেবে বিক্রি হওয়া বিবার, শজারু বা সাপ- যেকোনো থেকেই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে উহানের লোকজন বাদুর আর ইঁদুরের স্যুপ খায় বলে তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ
গুজব প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে ঠাণ্ডা মাথার আমলাতন্ত্র। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এই রোগের ওষুধ আবিষ্কার ও টিকা আবিষ্কারের দিকে মনোযোগী হতে হবে। সেইসাথে বিশ্ববাণিজ্যও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকেও নজর রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, উহান থেকে ভাইরাসটি ছড়ালেও অন্য দেশ থেকেও এর বিস্তার ঘটাতে পারত। সেক্ষেত্রে ওই দেশকে পুরোপুরি দায়ী করাটা হতো ভুল। আবার পাশ্চাত্যের দেশগুলো অন্যদের তাচ্ছিল্য করার মানসিকতাও প্রদর্শন করতে পারে। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের একটি আশঙ্কার কথা বলা যায়। এসব দেশে অ্যান্টিবায়োটিক খুব বেশি মাত্রায় ব্যবহার করা হয়। ফলে পাশ্চাত্য থেকেই ব্যাকটেরিয়াল রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। আর তা যদি ঘটে তবে তার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ।
পাশ্চাত্য থেকে কেবল ব্যাকটেরিয়াল রোগই ছড়াবে তা নয়। আরো রোগের বিস্তারও ঘটতে পারে। ১৯৫০-এর দশকে কানাডা থেকৈ পাওয়াসান ভাইরাসের বিস্তার গটেছিল। সেটা অনেক দূর ছড়িয়েছিল। আবার মশাবাহী জিকা ভাইরাস আফ্রিকায় আবির্ভূত হলেও এটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল পাশ্চাত্যে। আর ২০১৫-১৬ সময়কালে আমেরিকার ২৬টি দেশে আঘাত হেনেছিল। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ব্রাজিল। এখানে ১৫ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছিল। আর কলম্বিয়ায় দেখা গিয়েছিল ২৫ হাজার ঘটনা। বিশ্বের নানা অঞ্চলে এই রোগের আরো অনেক শিকার দেখা গিয়েছিল।
ড. মার্শাল লিয়েঁর মতে, যেকোনো অঞ্চল থেকে যেকোনো রোগ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন কোনো রোগ নেই যা বিশেষ কোনো অঞ্চলে উৎপত্তি হয়েছে বলেও সেই স্থানটি দায়ী। এ কারণে কাউকে দায়ী করার বদলে সবাইকে রক্ষার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
যেভাবে করোনা ভাইরাসকে দমন করা যেতে পারে।
ভয়াবহ ভীতি ছড়ানোর কারণেই চীনা কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোরভাবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নির্মমতার পরিচয়ও দিচ্ছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি যে কঠিনভাবে এই রোগটি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে, তার সমালোচনাও দেখা গেছে। অন্যদিকে চিকিৎসক ও নার্সেরা হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছে জীবনের তোয়াক্কা না করে। নির্মাণশ্রমিকেরা একেবারে দুটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করে ফেলেছে। এখানে ২৩ শ’ রোগীর পরিচর্যা করা সম্ভব।
এদিকে পাকিস্তান প্রস্তাব দিয়েছে একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের। এখানে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা করানো সম্ভব। জার্মানি তাদের উদ্ভাবিত ওষুধ পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
এই রোগটি মোকাবিলার জন্য দরকার সাহস আর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এখন আমাদের দেশে কেউ নেই বলে চোখ বন্ধ করে থাকলে চলবে না। সবাইকেই সাহসে ভর করে এগিয়ে আসতে হবে।