খালেদা জিয়ার মুক্তির পথে বাধা এখন ২ মামলা
কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন নেয়া বাকি রয়েছে। এ ছাড়া অন্য সব মামলায় তিনি জামিনে আছেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এরপর আইনি পথে জামিনের চেষ্টার পাশাপাশি গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার জন্য উন্নত চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়ার প্রধান আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে বলেন, সব নাগরিকের এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদেরও সংবিধান অনুযায়ী সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একজন বয়স্ক মহিলা। বর্তমানে তিনি কারাগারে গুরুতর অসুস্থ। তার দণ্ড স্থগিত করে দেশে বা বিদেশে তার ইচ্ছা মতো উন্নত চিকিৎসা নেয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা আশা করি সরকার এ ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্যথায় একটি ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে। সরকারকে এ জন্য জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো সরকারই চিরস্থায়ী নয়। তাই আমরা আশা করব সরকার বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়ার জন্য সংবিধান ও আইনের বিধান মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া একজন বয়স্ক মহিলা এবং অত্যন্ত অসুস্থ। সে কারণে সরকারের উচিত হবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় সাজা স্থগিত করে তার জীবন রক্ষার জন্য মুক্তি দিয়ে তাকে উন্নত চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দেয়া। তিনি বলেন, ৪০১(১) ধারায় সেই সুযোগ রয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে যেকোনো দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দিতে পারে। আর এটা সরকারের একক দায়িত্ব, এখানে কারো কোনো আবেদন করতে হয় না।
খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে তার মধ্যে আর দু’টি মামলায় জামিন পেলে তার কারামুক্তিতে বাধা থাকবে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একজন বয়স্ক মহিলা। আইনের বিধান আছে, তার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় তিনি জামিন পাওয়ার হকদার বা অধিকারী। এ কারণে তিনি বাকি দু’টি মামলায়ও জামিন পেতে পারেন।
এ বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তার জামিন নিতে হবে। তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় সরকার যেকোনো সময় খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারেন। কেননা তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় আটক রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, আইনাঙ্গনের অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ইচ্ছাকৃতভাবে আইন ও সংবিধানের তোয়াক্কা না করে তার কারাবাস দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। তিনি বারবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সে জন্য সরকারেই উচিত হবে ৪০১(১) বিধানকে অনুসরণ করে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। নারী শিক্ষার অগ্রগতির পাইওনিয়ার এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি আপসহীন নেত্রী। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। দেশের সর্ববৃহৎ দলের চেয়ারপারসন। এসব দিক বিবেচনা করে বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার মুক্তি দেবে বলে আমরা আশা করি।
খালেদা জিয়ার বেশির ভাগ মামলার আইনজীবী প্যানেলের সদস্য অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি প্রক্রিয়ার সাথে সাথে সরকারের সদিচ্ছাও থাকতে হবে। তা না হলে শুধুমাত্র আইনি পথে এ মুহূর্তে তার মুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমানে তার মুক্তির জন্য জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে জামিন নিতে হবে। সরকার বা অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষ থেকে বাধা সৃষ্টি না করা হলে এই দুই মামলায়ও জামিন পাওয়া সম্ভব।
আইনজীবীরা জানান, ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে। নি¤œ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দায়ের করা আপিলে সাজা ১০ বছর করা হয়, যা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। অপর দিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় নি¤œ আদালত খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। হাইকোর্টে এই সাজার বিরুদ্ধে আপিল ও জামিন আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর আপিল বিভাগে জামিন আবেদন করা হলে আপিল বিভাগ তা খারিজ করেন।
বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে নবনির্মিত ২ নম্বর ভবনে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতির মামলার অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ড্যান্ডি ডাইং মামলাটিও স্থগিত রয়েছে। অন্য দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি, জন্মদিন পালন এবং জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে আরও ৩২টি মামলা রয়েছে।
এ মামলাগুলো ২০১৪ সালের পর বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। মূলত রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি, ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে এসব মামলা হয়। পুলিশ, সরকারি দলের নেতাকর্মী ও আইনজীবীরা ওইসব মামলা করেছেন। তার মধ্যে বেশির ভাগ মামলা হয়েছে ঢাকায়। কুমিল্লায় তিনটি এবং পঞ্চগড় ও নড়াইলে একটি করে মামলা দায়ের করা হয়।
ঢাকার মামলাগুলোর মধ্যে হত্যা ও নাশকতার মামলা ১৩টি। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপিসহ ২০ দলের ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় বাসে আগুন, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, মানুষ হত্যাসহ বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ১০টি মামলায় চার্জশিট দেয় পুলিশ। যার মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় দু’টি ও দারুস সালাম থানায় আটটি মামলা। এ ছাড়া ঢাকার অপর মামলাগুলোর মধ্যে ভুয়া জন্মদিন পালন, ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্যের জন্য মানহানির মামলা এবং ২০১৫ সালে গুলশানে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিলে পেট্রলবোমা হামলার মামলা উল্লেখযোগ্য।