প্রশ্ন উঠেছে দেশে চামড়া খাতে সমস্যা কোথায়?

0

দেশে প্রতিবছর পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়ছে। তাতে বাড়ছে চামড়ার জোগান। কিন্তু বিপুল সুযোগ থাকার পরও এ খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারের ১ শতাংশও অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। রপ্তানি বাজারে নামমাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হিস্যা রয়েছে বাংলাদেশের দখলে। তাছাড়া বৈশ্বিক বাজারে দেশের চামড়ার দর কমেছে। অন্যদিকে শতভাগ কাঁচামাল দেশে উৎপাদন হলেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে– আসলে দেশে চামড়া খাতে সমস্যা কোথায়?

ট্যানারি মালিকদের দাবি, সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জন্য স্থায়ী ভাগাড় বা ডাম্পিং ইয়ার্ডও গড়ে ওঠেনি। তাতে পরিবেশ দূষণ রয়ে গেছে। ফলে ট্যানারিগুলো লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না। এ সনদ না থাকায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রকৃত দর থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশ। ফলে কাজে লাগানো যাচ্ছে না দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ রপ্তানি খাতের সম্ভাবনাকে। তাছাড়া বিকল্প পণ্যের কারণে সারাবিশ্বে চামড়ার চাহিদা এবং দাম কমছে। এটিও রপ্তানি কমার একটি কারণ।

তারা বলছেন, চামড়া শিল্পনগরের কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত বিষয়েও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অসহযোগিতা রয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানিতে যে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হতো, তা কমিয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে ট্যানারিগুলো লোকসানে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো ট্যানারি কারখানাকে এলডব্লিউজি সনদ পেতে হলে অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ সনদ অর্জনে ব্যর্থতার জন্য যেমনি সরকারের দায় রয়েছে, তেমনি অবহেলা রয়েছে ট্যানারিগুলোরও। তবে এ সনদ পাওয়া গেলে এ খাতের রপ্তানি আয়ে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

ট্যানারি মালিক ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চামড়া খাতে পরিবেশ দূষণরোধ, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও রপ্তানি বাড়াতে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। আধুনিক এ ট্যানারি শিল্প প্রকল্পটিতে ব্যয় করা হয় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। এর পর ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলোকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৬২টি ট্যানারির মধ্যে বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে ১৪০টি। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও সেখানে এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি সিইটিপি। স্থায়ী ব্যবস্থা হয়নি কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র মিলছে না। এ কারণে এলডব্লিউজি সনদও পাচ্ছে না সাভারের ট্যানারিগুলো। সে জন্য বাধ্য হয়ে খুব কম দামে চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে চীনসহ কিছু দেশে।

এলডব্লিউজি কী

লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি হলো চামড়া খাতের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। বিশ্বব্যাপী পরিবেশগতভাবে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে বিষয়টি তদারকি করে তারা। ভারতে ১৩৯টি, চীনে ১০৩টি, ইতালিতে ৬৮টি, ব্রাজিলে ৬০টি, তাইওয়ানে ২৪টি, স্পেনে ১৭টি, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬টি এবং ভিয়েতনামে ১৪টি ট্যানারি এ সনদ পেয়েছে। বাংলাদেশে এ সনদ পেয়েছে মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো– অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, এবিসি লেদার, রিফ লেদার, এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, সুপারএক্স লেদার ও সাইমন ট্যানিং ইনকরপোরেটেড (বাংলাদেশ)।

রপ্তানি কমছে

বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের (জুলাই-মে) ১১ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৯৬ কোটি ডলারের পণ্য, যা তার আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১২ কোটি ডলার। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।

বছর বছর পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়লেও সেই হারে চামড়া রপ্তানি বাড়ছে না। বরং অনেক কমেছে। এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শুধু চামড়া রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে চামড়া রপ্তানি হয়েছে ১২ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের। যদিও তা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সামান্য বেশি। ওই সময় রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার।

তিনটি কারণে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমছে বলে মনে করেন লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও লেদারেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান। সমকালকে তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। তাছাড়া চামড়াজাত পণ্য অনেকটা লাক্সারিয়াস। তাই নন-লেদার পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, দেশীয় ট্যানারি শিল্পে সিইটি সম্পন্ন না হওয়া।

রপ্তানিতে কমলো প্রণোদনা

রপ্তানিতে ধুঁকতে থাকা চামড়া খাতেও সম্প্রতি প্রণোদনা কমিয়েছে সরকার। যদিও ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে। চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ফিনিশড লেদারে প্রণোদনা ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। তবে ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে ৬ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যাবে।
চামড়া খাতের ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, এমনিতেই এ খাতে রপ্তানি কমছে। তাতে উদ্যোক্তারা শঙ্কায় রয়েছেন। প্রণোদনা কমলে আরও কমে যাবে রপ্তানি আয়। তাতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উদ্যোক্তারা।
দেশে কাঁচা চামড়ার দাম তলানিতে

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বছর ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১০৬টি বেশি। গত বছর সারাদেশে ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছিল। এদিকে, পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দর কমছে। করোনা অতিমারির সময় ২০২০ সালে দাম না পেয়ে অনেকেই খালে কিংবা ময়লার ভাগাড়েও পশুর চামড়া ফেলে দিয়েছেন। আর দুই-তিন বছর ধরে কাঁচা চামড়ার দর ৫০০ টাকার বৃত্তেই আটকে আছে। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক দশক আগেও লবণযুক্ত প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম গড়ে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা ছিল। গত দুই-তিন বছরে এ দর গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় নেমে এসেছে।

ঢাকার তেজগাঁও এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী ইউসুফ মিয়া জানান, ৮ থেকে ১০ বছর আগে একটা চামড়া কিনতে খরচ হতো অন্তত দেড় হাজার টাকা। এ বছর কোরবানির সময় তিনি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় অনেক চামড়া কিনেছেন।

চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়ে ট্যানারি মালিকরা নানা যুক্তি দাঁড় করান। তারা বলছেন, কমপ্লায়েন্ট না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ক্রেতা দেশ তাদের পণ্য নিচ্ছে না। ফলে নন-কমপ্লায়েন্ট বায়ারদের কাছে তুলনামূলক অনেক কম দামে চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে। রপ্তানি মূল্য কমার কারণে কাঁচা চামড়ার দাম কমছে।

ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, নামমাত্র দামে কাঁচা চামড়া এখন চীন-ভিয়েতনামে রপ্তানি করতে হয়। চামড়ার দাম বাড়াতে হলে প্রথম ধাপে ২০টি ট্যানারিকে এলডব্লিউজি সনদ অর্জন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ট্যানারিকে এ সনদের আওতায় এনে ট্যানারি শিল্পে উৎপাদিত চামড়া ব্র্যান্ড বায়ারদের কাছে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে। এ উদ্যোগ নেওয়া হলে এক বছরের মধ্যে কাঁচা চামড়ার দাম বেড়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্বের চামড়াশিল্পের কাঁচামালের যে চাহিদা রয়েছে, তার প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। কিন্তু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক রপ্তানির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। রপ্তানি বাড়াতে এলডব্লিউজি সনদ লাগবেই। সাভারে স্থাপিত সিইটিপি কোনোভাবেই মানসম্মত নয়। তবে সিইটিপির মান উন্নয়নের পাশাপাশি ট্যানারিগুলোকে তাদের নিজস্ব কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে।

ড. মিজানুর রহমান বলেন, সাভারে দু-চারটি ছাড়া বাকি ট্যানারিগুলোতে কোনো ধরনের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা হয়নি। ট্যানারির ভেতরে কাজের পরিবেশ একেবারে খারাপ। ট্যানারিগুলোর নিজেদের পরিবেশ উন্নত করা জরুরি।

সাভারে ট্যানারি শিল্পটি স্থাপন করা হয়েছে বিসিকের তত্ত্বাবধানে। এ ক্ষেত্রে বিসিকের অনেক অদক্ষতা রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ট্যানারি স্থাপনের জন্য সাভারে অনেক উদ্যোক্তাকে ১০ বা ২০ হাজার বর্গফুটের প্লট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এত ছোট জমিতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আবার দেখা গেছে, কোনো কোনো ব্যক্তিকে ৫০ হাজার বা ১ লাখ বর্গফুটের জমি দেওয়া হয়েছে। তারা জমি বরাদ্দ নিয়ে ট্যানারি করেনি। তাই বিসিকের উচিত প্লটগুলো ফের বণ্টন করে প্রকৃত ট্যানারি মালিকদের বরাদ্দ দেওয়া।

রপ্তানি বাড়াতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন। তিনি বলেন, রপ্তানি বাড়াতে সাভারের শিল্পনগরীকে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব হতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনা দরকার। ঋণ পুনঃতপশিলের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের বিদ্যমান স্বল্পমেয়াদি ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করতে হবে। হাজারীবাগের জমির সদ্ব্যবহার ত্বরান্বিত করে উদ্যোক্তাদের আর্থিক সংকট দূর করতে হবে।

সূত্র: সমকাল

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com