সমর্থকদের কাছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সত্যের পক্ষে একজন সাহসী প্রচারক
সমর্থকদের কাছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সত্যের পক্ষে একজন সাহসী প্রচারক। তবে, সমালোচকদের কাছে তিনি একজন প্রচারপ্রার্থী, যিনি অসংখ্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে অনেকের জীবনকে বিপন্ন করেছেন। অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারা তাকে তীব্র, চালিত এবং কম্পিউটারের কোডগুলো ক্র্যাক করার ব্যতিক্রমী ক্ষমতার প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন, যা গোপনীয় নথি এবং ছবি প্রকাশ করে। ২০১০ সালের এপ্রিলে, ইরাকে একটি হেলিকপ্টার থেকে মার্কিন সেনারা ১৮ জন বেসামরিক নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে। উইকিলিকস ওই ঘটনার ফুটেজ প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে খবরের শিরোনাম হয়। এজন্য পরের বছর এই অস্ট্রেলিয়ানকে যুক্তরাজ্যে আটক করা হয় এবং পরে জামিন দেওয়া হয়। যদিও তার আগেই যৌন নিপীড়নের অভিযোগে সুইডেন তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
অ্যাসাঞ্জ মনে করেন, এটা ছিল- শেষ পর্যন্ত তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের একটি চক্রান্ত। একইসঙ্গে, এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা যা গত ১৪ বছর ধরে চলমান এবং এর সঙ্গে পাঁচটি দেশকে যুক্ত করার পাশাপাশি বিশ্বের কয়েকটি সর্বোচ্চ আদালতেও এই মামলা পৌঁছেছে। কিন্তু ৫২ বছর বয়সী অ্যাসাঞ্জ এখন মুক্ত-জামিনপ্রাপ্ত।
হ্যাকার হিসেবে যেভাবে শুরু
অ্যাসাঞ্জ সাধারণত তার অতীত সম্পর্কে কথা বলতে অনিচ্ছুক। তবে উইকিলিকসের উত্থানের পর থেকে মিডিয়ার আগ্রহের ফলে তার প্রভাব সম্পর্কে সূক্ষ্ম কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। তিনি ১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা-মা ভ্রাম্যমাণ একটি থিয়েটার পরিচালনার কারণে তার শৈশব কেটেছে বিক্ষিপ্তভাবে। ইন্টারনেটের বিকাশ তাকে গণিতের বিষয়ে তার প্রাথমিক দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেয়। তবে, এটি তাকে বেকায়দায়ও ফেলেছিল। ১৯৫১ সালে অ্যাসাঞ্জ তার এক বন্ধুর সঙ্গে কয়েক ডজন হ্যাকিং কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত হন। যদিও তাদের হ্যাকার দলটি ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়াতে যথেষ্ট দক্ষ ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অ্যাসাঞ্জ ধরা পড়েন এবং দোষী সাব্যস্ত হন।
তাকে কয়েক হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার জরিমানা করা হয়েছিল এবং শুধুমাত্র এই শর্তে কারাভোগ রেহাই পান যে, তিনি পুনরায় অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবেন না। পদার্থবিদ্যা ও গণিত অধ্যয়ন করার আগে তিনি সহ-লেখক হিসেবে ইন্টারনেটের ধ্বংসাত্মক দিক নিয়ে একটি বই লেখেন, যা ব্যাপক সাড়া ফেলে।
উইকিলিকসের যাত্রা ২০০৬ সালে, ওয়েব জগতের সমমনা লোকজনকে নিয়ে অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকসের যাত্রা শুরু করেন। যেখানে তথ্য ফাঁসকারীদের জন্য একটি ওয়েব-ভিত্তিক ‘ডেড-লেটারবক্স’ তৈরি করা হয়েছিল। তিনি ২০১১ সালে বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের তথ্যের উৎস সুরক্ষিত রাখতে এবং সম্পদকে (তথ্য) এনক্রিপ্ট করা এবং ছড়িয়ে দিতে হয়েছে।’ এজন্য যাযাবরের জীবন বেছে নেওয়ার পাশাপাশি তিনি উইকিলিকসকে অস্থায়ী এবং বিভিন্ন স্থান থেকে পরিচালনা করতেন।
নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক রাফি খাচেদোরিয়ান, যিনি অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ সময় কাটিয়েছেন। তার মতে, অ্যাসাঞ্জ না খেয়ে, দীর্ঘ সময় ধরে একটানা কাজ করতে পারেন, এমনকি খুব কম ঘুমিয়েও কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন।
রাফি আরও বলেন, তিনি তার চারপাশে এমন পরিবেশ তৈরি করেন যে, তার কাছের লোকেরা তার যত্ন নেওয়া এবং তাকে চলতে সাহায্য করতে চায়। আমি বলব যে, তার এমন ক্যারিশমা রয়েছে যা দিয়ে সে কিছু করতে পারে।
কিন্তু ২০১০ সালে উইকিলিকস এবং অ্যাসাঞ্জ-ইরাকে বেসামরিক লোকদের ওপর মার্কিন হেলিকপ্টারের গুলি চালানোর ফুটেজ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ভিডিওটি প্রচার এবং সেটিকে রক্ষাও করেছিলেন। একইসঙ্গে তিনি ২০১০ এর জুলাই এবং অক্টোবরে আফগান ও ইরাক যুদ্ধের বিষয়ে বিপুল সংখ্যক মার্কিন সামরিক গোপন নথি প্রকাশ করেন। হুইসেলব্লোয়িং ওয়েবসাইটটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গোয়েন্দা সংস্থা স্ট্র্যাটফোরের কাছ থেকে পাঁচ মিলিয়ন গোপনীয় ইমেলসহ বিপুল পরিমাণে নতুন নথি প্রকাশ করে।
তবে, বেশ কয়েকটি মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুদান বন্ধ করে দেওয়ায় শিগগিরই উইকিলিকসকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে এক নারীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি এবং ২০১০ সালের আগস্টে স্টকহোমে বক্তৃতা দেওয়ার সময় অন্য এক নারীকে নিগৃহীত করার অভিযোগ এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাড়া করে বেড়াতে শুরু করে। ওই বছরের শেষ দিকে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরোয়ানা জারি করা হয়।
ইকুয়েডরের আশ্রয়দানের প্রস্তাব অ্যাসাঞ্জ বলেছেন, তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণ সম্মতির ভিত্তিতে হয়েছে। তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ধর্ষণের অভিযোগগুলি আনা হয়েছে। ওই পরোয়ানার বিরুদ্ধে লড়তে তাকে আদালতে দেড় বছর ব্যয় করতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট পরোয়ানা বহাল রাখলে, অ্যাসাঞ্জ ইকুয়েডরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরেয়ার কাছে সাহায্য চান। অতীতে তারা দু’জন স্বাধীনতার ব্যাপারে অভিন্ন মত প্রকাশ করেছিলেন।
প্রত্যর্পণ এড়াতে ২০১২ সালের জুনে, তিনি লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। দূতাবাসে অবস্থানকালে মাঝে মাঝে বিবৃতি এবং সাক্ষাত্কার প্রদান করতেন তিনি। সেসময় তিনি প্রেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের লেভেসন ইনকোয়ারিতে একটি আবেদন জমা দেন। তাতে বলেন, তিনি ‘ব্যাপক ভুল এবং নেতিবাচক মিডিয়া কভারেজ’ এর শিকার হয়েছেন।
দূতাবাসের ভেতরে প্রায় সাত বছর কাটানোর পর, অ্যাসাঞ্জকে নাটকীয়ভাবে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ইকুয়েডরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লেনিন মোরেনো অ্যাসাঞ্জের বিষয়ে বলেছিলেন যে, তিনি তার পূর্বসূরি থেকে পরিস্থিতি ‘উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন’।
টুইট পোস্টে তিনি আরও বলেন, তার দেশ অ্যাসাঞ্জের আশ্রয় প্রত্যাহারের বিষয়ে ‘একটি সার্বভৌম সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে। মি. মোরেনো আরও বলেন, তবে অ্যাসাঞ্জকে যাতে এমন কোনও দেশে প্রত্যর্পণ করা না হয়, যেখানে তিনি নির্যাতন বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন মর্মে বৃটেনের কাছে অনুরোধ করেছিলো ইকুয়েডর।
আইনি টানা-হেঁচড়ার কাহিনি অ্যাসাঞ্জকে সেন্ট্রাল লন্ডন পুলিশ স্টেশনে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল- ২০১২ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ২০১৯ সালের ১ মে তাকে ৫০ সপ্তাহের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পর সুইডিশ প্রসিকিউটররা ২০১০ সালের ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে তড়িঘড়ি করে তাদের তদন্ত পুনরায় চালু করে এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে অ্যাসাঞ্জকে ২০১০ সালের গোপন নথি প্রকাশ সম্পর্কিত ‘এসপ্যানিওজ অ্যাক্ট’ লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করে।
ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গোপন নথি ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনা’ বলে উল্লেখ করে। অন্যদিকে, উইকিলিকস এই ঘোষণাকে ‘পাগলামি’ এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তা সাংবাদিকতার অবসান’ বলে অভিহিত করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ ঠেকাতে অ্যাসাঞ্জ লড়াইয়ের জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমন সময় সুইডিশ প্রসিকিউটররা ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তদন্ত বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কারণ, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো ‘অভিযোগ দাখিলের ভিত্তি তৈরি করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়’। এরপর সিরিজ আবেদনে তার মামলা কখনো একটু এগুলে পাল্টা আবেদনে আবার পিছিয়ে পড়ে- এভাবে আইনি রশিতে বাধা পড়ে। ২০২১ সালে একটি ব্রিটিশ আদালত তার প্রত্যর্পণকে বাধা দিয়ে তার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার সফলভাবে আপিল করে। সর্বশেষ, মাত্র ক’মাস আগে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্ত জানায় যে, অ্যাসাঞ্জ মার্কিন প্রত্যর্পণের আদেশের বিরুদ্ধে আবারও আপিল করতে পারেন। লন্ডনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বেলমার্শ কারাগারে এই পুরো সময়টা অ্যাসাঞ্জ বসে কাটান।
এর মধ্যে ২০২২ সালে বেলমার্শ কারাগারে তিনি তার সাত বছরের সঙ্গী, দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী এবং তার আইনজীবী দলের দীর্ঘদিনের সদস্য স্টেলা মরিসকে বিয়ে করেন। তিনি অ্যাসাঞ্জের দুই সন্তানের মা। অ্যাসাঞ্জ ইকুয়েডর দূতাবাসে অবস্থানকালে মরিস গর্ভধারণ করেন। অ্যাসাঞ্জের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল যে, তার স্বাস্থ্যের ক্রমাগত এবং নাটকীয়ভাবে অবনতি হচ্ছে এবং তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে, অ্যাসাঞ্জ হয়তো মারা যাবেন অথবা আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু আইনি টানাহেঁচড়া চলতে থাকল। তবে, জনসাধারণের প্রচারণা এবং অ্যাসাঞ্জের নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে মামলাটি সমাধানের জন্য বৃটেইন ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী এন্থনি অলব্যানিজ দেশটির পক্ষ থেকে বলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়’। তিনি আরও বলেন, ‘এই ব্যাপারটি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না’।
অন্যদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নসহ (এসিএলইউ) অধিকার সংস্থাগুলো তাকে মুক্তি দেওয়ার আহবান জানায়। তারা বলেন, অ্যাসাঞ্জের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ এবং তার মামলা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি। তিনি ইউকে লেবার পার্টির প্রাক্তন নেতা জেরেমি করবিন, ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি, বেওয়াচের তারকা পামেলা অ্যান্ডারসন এবং প্রয়াত ফ্যাশন আইকন ডেইম ভিভিয়েন ওয়েস্টউডসহ বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী অগণিত ব্যক্তির সমর্থনও লাভ করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেলের মতো অ্যাসাঞ্জের সমালোচকরা বলেন, তিনি একজন সাংবাদিক নন এবং কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই নথিপত্র প্রকাশ করে জীবন বিপন্ন করছেন।