কোন পথে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা

0

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)- এ দুই সরকারি উদ্যোগ কতখানি সাংঘর্ষিক ও অসাংবিধানিক, তা প্রমাণে সেদেশের জনগণ দীর্ঘ ৭০ বছর পর সংবিধান হাতে পথে নেমেছে।

দীর্ঘ সময় পর খোদ সংবিধানই রক্ষাকবচ হিসেবে সাধারণ মানুষকে শক্তি জোগাচ্ছে। যদিও সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটি যোগ হয়েছে অনেক পরে, ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে।

কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার আবহ ও অনুশীলন সেই সংবিধান রচনার সময় থেকেই ভারতে বিদ্যমান ছিল। ভারতীয় ‘সেকুলারিজম’ আসলে সংবিধানের কাঠামো নির্মাণে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়, এ হল সেই দর্শন যা সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বহু মত-বহু পথের সম্মিলন ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে সম্মানের সঙ্গে অক্ষুণ্ন রাখে।

সরকার যতই সিএএ ও এনআরসি প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে, ততই সংবিধানের প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রবল হচ্ছে এবং নাগরিকত্ব হরণের মতো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান যে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, জনগণই সেই বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ মহার্ঘ আবহ তৈরির কুশীলব ভারতের জনগণ। এ সেই জনগণ, যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদের শুধু ভারতীয় বলেই জেনে এসেছে এতকাল। এবং কোনোদিন অবচেতনেও ভাবেনি এই ভারতীয় পরিচয়ের বাইরে তাদের ধর্মের ভিত্তিতে নতুন করে কেউ নাগরিকত্ব দেয়ার ব্রত পালনে এগিয়ে আসবে। কারণ জীবনভর তারা জেনে এসেছে নাগরিকত্ব আসলে একটা অনুশীলন, একটা বোধের চর্চা। আর সেই চর্চায় ইতিমধ্যেই তারা সসম্মানে উত্তীর্ণ। সে উত্তরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা কেউ কোনোদিন দেখায়নি, দেখাবে বলেও তারা ভাবেনি। কিন্তু হায়, এমন কঠিন সময় স্বাধীন ভারতে কখনও আসেনি। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনা এবং সারা দেশের জন্য এনআরসি তৈরির অঙ্গীকার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভারতকে ঠেলে দিয়েছে অনেক পেছনে, অন্ধকারের কাছাকাছি।

এ অঞ্চলের প্রগতিশীল ব্যক্তিরা এক সময় ভারতকে প্রগতির ধারক-বাহক হিসেবে অন্তরে ঠাঁই দিয়েছিল। কালের পরিক্রমায় সেই ভারতই এখন তার ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক চেতনা হারিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত এটিই হচ্ছে প্রথম আইন, যেখানে ধর্মীয় বিভাজনের কারণে কিছু মানুষ হারাবে নিজের ভূখণ্ড, রাষ্ট্র, সর্বোপরি অস্তিত্ব। যদিও আইনে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টে নিষ্পত্তি হওয়া রামমন্দির-বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলন যেভাবে ঘটেছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ যে খুব বেশি সহানুভূতি পাবে না, তা সহজেই অনুমেয়।

গত সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির অঙ্গীকার ছিল ‘কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, রামমন্দির নির্মাণ’ এবং ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন’। অস্বীকার করার উপায় নেই, বিজেপির এসব পরিকল্পনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন ছিল, যা বিজেপিকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়েছে। বিজেপিও তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে বদ্ধপরিকর। সুপ্রিমকোর্টের অদ্ভুত রায় যেমন রামমন্দির নির্মাণের পথ পরিষ্কার করেছে, কাশ্মীরকে বিশেষ অধিকারসমৃদ্ধ রাজ্য থেকে বিভক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে, তেমনি তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের পথও প্রশস্ত করতে সহায়তা করবে বলা যেতে পারে। হিন্দুরাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে নিশ্চিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে ভারত। ধর্মীয় আগ্রাসন একটা দেশকে কতটা পিছিয়ে দেয়, দেশের মানুষকে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ঠেলে দেয়, এ সময়ের ভারত তার উদাহরণ।

এ প্রক্রিয়াকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা হলেও সবচেয়ে বড় ঝড়টি বাংলাদেশের ওপর দিয়েই বইবে। তাই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এদেশের সরকার ও জনগণকে। সাম্প্রদায়িক শাসকের রক্তচক্ষু আর গুলি উপেক্ষা করে অস্তিত্বের সংকটে পড়া অসহায় মানুষের সঙ্গে জেগে উঠুক বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষ।

লাভা মাহমুদা : শিক্ষক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com