আরেক যুদ্ধে এরদোগান-নেতানিয়াহু
নানামুখী কৌশলগত খেলায় মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। কোনো কোনো দেশকে এই মেরুকরণে সামনে রেখে দাবার ঘুঁটি সাজাচ্ছে ভিন্ন শক্তিগুলো। এই খেলায় মধ্যপ্রাচ্যের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত দৃশ্যত বেশ সামনে চলে এসেছে। দেশটি আগ্রাসী কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলের মাধ্যমে তুরস্কের মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে। এটি ঘটছে অনেকটাই তুরস্ক-ইসরাইল বা ইরান-ইসরাইল ছায়াযুদ্ধে ইসরাইলের টুলস হিসেবে। আরব, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি মুসলিম বিশ্বে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছে আমিরাত।
মিসর, ইয়েমেন ও সুদানের পর লিবিয়ায় খলিফা হাফতারকে সামনে রেখে এবং সর্বশেষ ট্রাম্পের নেতানিয়াহুকে সাথে নিয়ে ঘোষণা করা ‘শতকের সেরা চুক্তি’কে কেন্দ্র করে ইসরাইলের নেপথ্য সমর্থনে আমিরাত বেশখানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় নেমেছে বলে মনে হচ্ছে। এই খেলায় নেপথ্য সমর্থনকারী হিসেবে ইসরাইলের সাথে সৌদি আরব এবং ক্ষেত্রবিশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকার কারণে আবুধাবির উচ্চাভিলাষী ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন জায়েদ নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন অবয়বদাতার ভূমিকায় নিয়ে যেতে চাইছেন। এতে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে এমন এক বেপরোয়া অবস্থানে চলে এসেছে, যার ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইরান আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রে তুরস্কের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। আসলে ছায়াযুদ্ধটি হচ্ছে ইসরাইলের সাথে।
সর্বশেষ তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়েব এরদোগান আলজেরিয়া সফরের এক দিন পরই সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একই দেশ সফর করেছেন। তার এই সফর সম্পর্কে তুর্কি কলামিস্ট মেহমেট এসিট বলেছেন, ‘তিনি কী জন্য সেখানে গেছেন সে সম্পর্কে যে কেউ অনুমান করে নিতে পারেন। তিনি হয়তো পরামর্শ দিয়েছেন, ‘এই লোক (এরদোগান) যেটি বলেছেন তেমনটি আপনি করবেন না, আপনি আমাদের কথা শুনুন।’
বেশ কিছুদিন ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাত খোলামেলা এবং বারবার তুরস্কের সমালোচনা করছে। আরব আমিরাতের বিদেশবিষয়ক মন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ঘোষণা করেন, ‘ইরান, তুরস্ক বা ইসরাইল যে দেশ থেকে হোক না কেন- আরব ভূমিতে আক্রমণ করা, আরব স্বার্থে আক্রমণ করা এবং আরব বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ আমরা দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি।’
লক্ষণীয় যে, তুরস্ক ওয়াইপিজিকে আফরিন থেকে সরিয়ে দেয়ার ঠিক পরই আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতি এসেছে। অতি সম্প্রতি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের একটি নিরাপদ অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে তার দেশ। তিনি আরো বলেছেন, সিরিয়ান কুর্দিদের অবশ্যই তুরস্কের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত।
আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইলের সাথে ইরান ও তুরস্ককে একই ব্রাকেটে ফেলে কয়েকটি বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। প্রথমত, আমিরাতের কাছে মুসলিম উম্মাহ বা উম্মাহর স্বার্থ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আরব স্বার্থ বিবেচনায় ইসরাইলের মতোই শত্রু বিবেচনা করা হবে তুরস্ক বা ইরানকে। দ্বিতীয়ত, বৈরিতার ক্রমে ইরান তুরস্ক আগে আর এরপর ইসরাইলকে রাখা হলেও বাস্তব নীতির ক্ষেত্রে প্রথম দুই দেশের বিপরীতে ইসরাইলের সাথে বিশেষ মৈত্রী তৈরি হয়েছে আমিরাতের। এটি তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী পিকেকে লিঙ্ক ওয়াইপিজির ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, তেমনিভাবে মিসর-লিবিয়ায়ও একই নীতি দেখা গছে। সর্বশেষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত শতকের সেরা চুক্তি প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থিত ছিলেন আমিরাতের রাষ্ট্রদূত। এই ইস্যুতে আরব লিগ এবং ওআইসি ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের অবস্থানকে দৃশ্যত সমর্থন করেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমিরাতের ভূমিকা এর বিপরীত।
ইনি সাফাক পত্রিকার সম্পাদক ইব্রাহিম কারাগুল এটিকে বর্ণনা করেছেন জেরুসালেম বিক্রি হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘হ্যাঁ, জেরুসালেম বিক্রি হয়ে গেছে। প্রথম কেবলা বিক্রি হয়েছে, অত্যন্ত নোংরা আলোচনার জন্য এটি বলি দেয়া হয়েছে। ক্ষমতা অর্জনের জন্য যারা তেল বিনিময় করেছেন, তারা এখন জেরুসালেম বিক্রি করে বিদ্যুৎ কিনছেন। তারা আরব বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রে ইরানকে ভয় দেখিয়ে জেরুসালেম নিয়ে যাচ্ছে। তারা তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে এ অঞ্চলে ইরানের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। তারা জেরুসালেমের পক্ষের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তারা একই ধরনের আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকেও নিয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল তারা এ রকম আলোচনার মাধ্যমে মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণও নিতে চলেছে।’
ইব্রাহিম কারাগুল প্রশ্ন করেছেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোহাম্মদ বিন জায়েদ এবং সৌদি আরবের মোহাম্মদ বিন সালমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী নিয়ে আলোচনা করেছেন? আর ইসরাইল? তারা বলছেন, ‘আমরা এখন ইসরাইলের বন্ধু, আমরা এখন ইসরাইলের মিত্র, জেরুসালেম নিয়ে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।’ এভাবে তারা নিজের লোকদের এবং মুসলিম বিশ্বের জন্য এক মহাভারী মূল্য দিতে চলেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মোহাম্মদ বিন জায়েদ একজন চটজলদি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে পরিচিত। তার সম্পর্কে ধারণাটি হলো এমন- আপনি যদি তার ছবিটি একবার অবলোকন করেন তবে আপনি বলতে পারেন যে, তার চরিত্রটি তার চেহারায় বেশ ভালোভাবে প্রতিফলিত।
তুর্কি কলামিস্ট মেহমেট এসিট-এর মতে, “আঙ্কারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষত আরব বিশ্বের প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল তা নষ্ট করার জন্য এ ব্যক্তিটি তার সব উপায় ব্যবহার করে আসছেন। ‘আরব জাতীয়তাবাদ’ কার্ড খেলে তিনি আরব দেশগুলোর সাথে তুরস্কের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ব্যক্তিটি অভ্যুত্থান চেষ্টায় সমর্থন দিয়ে তুরস্কে অগণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার খারাপ দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। তুরস্কও শেষ পর্যন্ত আমিরাতকে তার বোধগম্য ভাষায় জবাব দিতে শুরু করেছে।”
২০১৭ সালের মে মাসে, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল ওতাইবা এরদোগানের অধীনে থাকা তুরস্ককে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই ‘দীর্ঘমেয়াদি হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ডিসেম্বর ২০১৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান একটি টুইট শেয়ার করেন, যাতে দাবি করা হয় যে, একজন অটোমান জেনারেল উসমানীয় শাসনের সময় মদিনায় ডাকাতিতে লিপ্ত হয়েছিলেন।
এরপর তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়েব এরদোগান তাকে একজন অসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে বলেছিলেন, তেলের গরমে তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসেছেন। আর আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ তখন বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ও পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য বিকল্প নয় এবং আরব বিশ্ব তেহরান বা আঙ্কারা গাইড দ্বারা পরিচালিত হবে না।’
মার্চ ২০১৮ সালে গারগাশ বলেছিলেন, দুই দেশের সম্পর্ক এখন আর তাদের সেরা অবস্থানে নেই। একই সাথে তিনি তুরস্ককে ‘আরব সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং প্রতিবেশীদের সাথে প্রজ্ঞা ও যুক্তি দিয়ে আচরণ করার’ আহ্বান জানান। মে ২০১৮ সালে, গারগাশ মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান তুর্কি এবং ইরানি প্রভাবের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। আসলে আমিরাতের নেতাদের মুখ থেকে ইসরাইলের কথাই প্রকাশ হচ্ছিল।
দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক মিসরীয় সঙ্কট ও পরবর্তীকালের পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন মনোভাবের কারণে বেশ তিক্ত হয়ে ওঠে। মিসরে তুরস্ক সমর্থন করে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত সরকারকে। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে, আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির অধীনে সামরিক সরকারকে।
এরপর সম্পর্ক আবারো তিক্ত হয়ে ওঠে তুরস্কে এরদোগানের বিরুদ্ধে আগে উল্লিখিত অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে। আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে ২০১৭ সালের জুনে ওতাইবার ফাঁস করা সিরিজ ই-মেইল অনুযায়ী, ২০১৬ সালের তুর্কি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় মদদ দিয়েছে আমিরাত। ২০১৭-১৮ কাতারের কূটনৈতিক সঙ্কটে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে। এ সময় সৌদি আরব মিসর বাহরাইনের সাথে জোট বেঁধে কাতারের বিরুদ্ধে আমিরাত অবরোধ আরোপ করলে তুরস্ক পাশে দাঁড়ায় কাতারের। আর আমিরাত কাতারকে দেয়া কূটনৈতিক সমর্থনের জন্য তুরস্কের তীব্র সমালোচনা করে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রথম দিকে দুই দেশের অবস্থান এক লাইনে থাকলেও পরে ব্যবধান তৈরি হয়। ২০১৭ সালের আগস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাত অভিযোগ করে, তুরস্ক সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে ‘সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব হ্রাসের চেষ্টা করে ঔপনিবেশিক এবং আধিপত্যমূলক আচরণ’ করছে। শুধু তাই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত উত্তর সিরিয়ায় তুর্কি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত কুর্দি সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে।
নানা ধরনের বৈরী আচরণের পরও আমিরাতের ব্যাপারে তুরস্ককে অনেক দিন চুপচাপই দেখা গিয়েছিল। তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর সাথে আমিরাতের সম্পৃক্ততার বিষয় প্রকাশ হলে আঙ্কারার দায়িত্ববান ব্যক্তিরা প্রথম মুখ খুলতে শুরু করেন। বছর তিনেক আগে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট শ্যাভুওলু বলেন, ‘একটি মুসলিম দেশ তুরস্কে অভ্যুত্থানের জন্য তিন বিলিয়ন ডলার তহবিল সরবরাহ করেছে।’ পরে অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই দেশটি ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০১৭ সালের জুনে রাষ্ট্রপতি এরদোগানও তার নীরবতা ভেঙে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রশাসনের কাছে একটি কঠোর বার্তা পাঠান। এক অনুষ্ঠানে এরদোগান বলেন : ‘যদি কোনো নির্দিষ্ট দেশের গোয়েন্দা সংস্থা থাকে তবে আমাদেরও তা রয়েছে। তারা সেই রাতটি (তুরস্কের অভ্যুত্থানের রাত) কিভাবে কাটিয়েছিল তা আমরা খুব ভালো করেই জানি। যারা এটি ফলো করেছিল, আমরা তাদের খুব ভালো করে জানি। আমরা জানি যে, তাদের অর্থ কিভাবে ব্যয় হয়।’
গত গ্রীষ্মে, আঙ্কারার একজন নীতিনির্ধারক সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে ‘ক্যান্সার সেল’ হিসেবে উল্লেখ করতে শোনা যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতকে। আমিরাতের সাথে একই ব্রাকেটে মিসর, সৌদি আরব এবং লিবিয়ার যুদ্ধবাজ জেনারেল খলিফা হাফতারের কথা উল্লেখ করে তিনি এই বলয়ের কাজ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপতি এরদোগানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একজন বলেছিলেন, তারা নিজ লোকদের সামনে নিজের আসনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। তুরস্কের মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাজপথ থেকে আসা দাবিগুলোর জন্য ‘বাধ্যতামূলক শাস্তি’ দিতে তারা প্ররোচিত করেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে, আমিরাত ‘ছায়ার মতো’ তুরস্কের বৈদেশিক নীতিকার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। তারা আঙ্কারার এক নতুন ধরনের পদ্ধতি দেখছে। যাতে মনে হচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত বুঝতে পারে এমন ভাষায় তুরস্ক জবাব দিতে শুরু করেছে।
এর প্রথম উদাহরণটি হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতের তুর্কিবিরোধী ক্রিয়াকলাপে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে ব্যবহৃত বিতর্কিত ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ দাহলানকে ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের লাল তালিকায় যুক্ত করা। তুর্কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেয়া এই সিদ্ধান্তের অর্থ হলো- মোহাম্মদ বিন জায়েদ তার ‘নোংরা কাজ’ করার জন্য যে ব্যক্তিকে ব্যবহার করেছিলেন তাকে পিকেকে থেকে আলাদাভাবে দেখা হবে না।
এটি এমন একটি শুরু, যা এত দিনের মৌখিক প্রতিক্রিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের তৎপরতায় তুরস্কের নতুন প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য লিবিয়ায় তুরস্কের উদ্যোগগুলোও দেখা যেতে পারে। ব্লুমবার্গে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ত্রিপোলিতে তুরস্ক বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে লিবিয়ার যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ পরিবর্তন করেছে।
আসলে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ভূরাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই লড়াইয়ে সামনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এতে ব্যবহার হচ্ছেন লিবিয়ার যুদ্ধবাজ জেনারেল খলিফা হাফতার। এর টুলস এবং অভিন্ন স্বার্থগত সমীকরণে অনেকখানি ব্যবহৃত হচ্ছে সৌদি আরব, মিসর ও বাহরাইন। আর এর নেপথ্যে মূল ভূমিকায় রয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের ’৮০-এর দশকে নেয়া ইনোন পরিকল্পনার মূল বিষয় হলো, আশপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা এবং শাসকদের ক্ষমতায় থাকা না থাকা ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলা। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শিয়া-সুন্নি আরব-অনারব যে মতভেদের বিষয়গুলো রয়েছে, সেটিকে চাঙ্গা করে রাখা এই কর্মকৌশলের একটি অংশ।
এই কৌশলের আরেকটি অংশ হলো, শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে ফেলা অথবা স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে দেয়া। এই কৌশলের শিকার হয়ে ইরাক লিবিয়া সিরিয়া ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এর পরের লক্ষ্যবস্তু হলো এ অঞ্চলের অন্য চার শক্তিধর দেশ সৌদি আরব, মিসর, ইরান ও তুরস্ক। প্রথম দু’টিকে ইসরাইল নীতিগত দিক থেকে মিত্র বা অনুগত করতে সক্ষম হয়েছে। মিসরের অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে বিবেচিত নীল নদের উজানে রেনেসাঁ বাঁধ দিয়ে একটি অর্থনৈতিক খড়গ তৈরি করা হয়েছে। এই বাঁধের ওপর মিসরের ৮০ শতাংশ কৃষি নির্ভরশীল। ইসরাইলের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে প্রধানত এই বাঁধ তৈরি করেছে ইথিওপিয়া। সৌদি আরবকে কাছাকাছি আনতে ব্যবহার করা হয়েছে ইরান হুমকিকে। ইয়েমেন ইরাক আর লেবাননের মাধ্যমে ইরানি প্রভাব সৌদি আরবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এখন ইরানি নিরাপত্তা হুমকি থেকে বাঁচানোর নামে সৌদি আরব ও তার মিত্র উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে কৌশলগত গোয়েন্দা সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে ইসরাইল। যার পথ ধরে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কাজ চলছে। আর ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমর্থনে বাধ্য করা হচ্ছে।
ইরানকে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে পঙ্গু করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাতী উপাদানগুলোকে উসকে দিয়ে অসন্তোষ ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। এর পথ ধরে শাসন পরিবর্তন সফল করার চেষ্টা হচ্ছে। তুরস্ককে বাগে আনতে অনেক আগে থেকেই কুর্দি ইস্যু ব্যবহার করা হচ্ছে। এরদোগান শক্তভাবে এটি মোকাবেলার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে তুরস্ক তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সক্রিয় হয়ে উঠলে তার সামনে সৌদি আমিরাত বলয় দিয়ে শক্ত বাঁধা সৃষ্টি করা হয়েছে। লিবিয়ায় হাফতারের অভিযান, সুদানের সৌদি-আমিরাতপন্থী সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন, সিরিয়ায় ওয়াইপিজিকে মদদ প্রদান এবং সবশেষে তুর্কি গোয়েন্দা প্রধানকে হত্যার হুমকি তারই অংশবিশেষ। ২০১৬ সালে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর এসব নতুন কৌশল সামনে আনা হয়েছে। ২০২৩ সালের নির্বাচনে এরদোগানের একেপিকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করা হবে পরবর্তী সময়ের প্রচেষ্টা। আমিরাত এখন সেই অপচেষ্টায় লাঠিয়ালের ভূমিকায় রয়েছে আরব জাতীয়তার কার্ড নিয়ে। যে কার্ড খেলে উসমানীয় খেলাফতের পতন ঘটানো হয়েছিল ব্রিটিশ- ফ্রান্সের সহায়তায়। এখনকার নতুন চেষ্টার পেছনে মূল ভূমিকা ইসরাইলের।