জান্তা সরকারকে যে ভিক্ষুরা সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সবাই ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’
অতি সম্প্রতি ইয়াঙ্গুন বা মান্দালয়ে গিয়ে থাকলে একটি বিষয় আপনার চোখে পড়ার কথা। শহরের বিভিন্ন স্থানে মার্সিজিড বা বেন্টলির মতো বিলাসবহুল গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। অবাক হবেন না— পুরো মিয়ানমারেই এই চিত্র। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর জান্তা সরকারকে যে ভিক্ষুরা সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সবারই ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ হয়ে গেছে।
সাধারণ জনগণ এই ভিক্ষুদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁরা সুবিধাবাদী চরিত্রের এসব ভিক্ষুদের ‘সেলেব (তারকা) মঙ্ক’, ‘দালাল ভিক্ষু’ বলে গালি দিচ্ছেন; সামাজিকভাবে বয়কট করেছেন। তবে এতে যে ভিক্ষুদের চরিত্র পাল্টাচ্ছে তা নয়। তাঁরা শুরুতেও যেমন নগ্নভাবে জান্তা সরকারকে সমর্থন দিতেন, এখনো তা-ই দিয়ে যাচ্ছেন। দেশজুড়ে জান্তাবাহিনীর বর্বরতার মুখেও তাঁরা নিশ্চুপ।
অথচ এই ভিক্ষুরা এতটা নির্লজ্জ ছিলেন না। রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁদের প্রতিবাদী চরিত্রও ছিল। একটা সময় ছিল, যখন এই ভিক্ষুরা রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন ছিলেন। তাঁরা ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি এই জান্তা সরকারের আগের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধেও তাদের বড় অংশ সরব ছিলেন এবং প্রকাশ্যে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এখন তাঁদের বেশিরভাগ ভোল পাল্টেছেন; নেতৃত্বস্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক ভিক্ষু সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাঁদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠেছে।
জান্তা সরকারের সঙ্গে ভিক্ষুদের এই সহগামী সম্পর্ককে ‘ম্যারেজ অব কনভেনিয়েন্স’ বা ‘স্বার্থসিদ্ধির বিয়ে’ হিসেবে বর্ণনা করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কারণ, জান্তা সরকারকে সহযোগিতার হাত যারা বাড়িয়েছেন, সেই ভিক্ষুদের সম্পদ যেমন বেড়েছে তেমনি তাদের জান-মাল সুরক্ষাও পেয়েছে। বিনিময়ে জান্তা সরকার বৈধতা পেয়েছে এবং ইসলামের প্রসার বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে হুমকির ফেলেছে বলে নিজেদের বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষক হিসেবে চিত্রিত করছেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে মিয়ানমারের রক্ষণশীল উগ্র জাতীয়তাবাদী ভিক্ষুরা জান্তা সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য এই হাত অভ্যুত্থানের আগে থেকেই বাড়ানো ছিল। ধর্মের গুটি ব্যবহার করে সুবিধা নিতে জান্তাবাহিনী সবসময়ই রক্ষণশীল বৌদ্ধ ভিক্ষু গোষ্ঠী হলো—মা বা থার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এই সংগঠনটির যাত্রা শুরু ২০১২ সালে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, এই গোষ্ঠী মিয়ানমারে জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষ ও ধর্মীয় সহিংসতা উসকে দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড চালাতে ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত মা বা থা নামের এই সংঘকে সরাসরি আর্থিক অনুদান, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছেন তৎকালীন জান্তা শাসক থেইন সেইন। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর বর্তমান জান্তা সরকারও একই ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারে জান্তার অনুকূলে ধর্মের গুটি খেলার দায়ে অভিযুক্ত প্রধান দুই ভিক্ষু হলেন—সিতাগু সায়াদাও আশিন ন্যানিসরা ও ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা। ৮৭ বছর বয়সী সিতাগু সায়াদাও মায়ানমারের নয়টি বৌদ্ধ ভিক্ষু গোষ্ঠীর একটি ‘শ্বে কিন’—সম্প্রদায়ের নেতা। সর্বশেষ অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারের মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় ও প্রভাবশালী ভিক্ষু হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। দেশ-বিদেশে হাজার হাজার অনুসারী ছিল তাঁর।
অপরদিকে, বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবছর শত শত তরুণ-তরুণীকে আকৃষ্ট করে নিজের খ্যাতি তৈরি করেছেন ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা। তিনি ইয়াঙ্গুনের ইন্টারন্যাশনাল থেরাবাদা বৌদ্ধ মিশনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং দেশব্যাপী তার কয়েক হাজার অনুসারী রয়েছে। এদের অনেকেই জান্তাবাহিনীর।
আশঙ্কার বিষয় হলো—২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর উভয় ভিক্ষু নেতাই জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ে সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছেন। এই দুজনই কয়েক মাস আগেই সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের আহ্বান জানান। জান্তার নৃশংসতা চোখের সামনে দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন তাঁরা উভয়েই।
২০২০ সালে সীতাগু সায়াদাওকে মিয়ানামারে সর্বোচ্চ ভিক্ষুর মর্যাদা দেয় জান্তা সরকার। এরপর তিনি জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংকে ‘রাজা’ উপাধিও দেন। তিনি বলেন, ‘মিন অং হ্লাইং মহৎ, মহানুভব ও প্রাজ্ঞ’ নেতা। অথচ তার আগেই এই জান্তাপ্রধানের হাত কয়েক হাজার মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে।
এই তোষামোদি বৃথা যায়নি, অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে নেপিদোর ‘রাজা’ বৌদ্ধ ধর্মের এসব ভিক্ষুদের নিরাশ করেননি। নগদ আর্থিক অনুদান, দামি গাড়ি, বিদেশ সফরের টিকিট, সরকারি সব পদক এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ের অংশীদারত্ব— এই ভিক্ষুদের সবকিছু ঢেলে দিয়েছেন।
জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিতাগু সায়াদাও আশিন ন্যানিসরা ও ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দার রাশিয়া সফরের সময় তাদের মধ্যেকার ‘অশুভ সম্পর্ক’ প্রকাশ্যে আসে। তবে এই ভাবমূর্তি ঢাকতে তাঁরা মস্কোয় মঠ উদ্বোধনের কাজে গিয়েছিলেন বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু আদতে জান্তা সরকারের অংশ হিসেবেই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন।
যুক্তরাজ্যের একটি দাতব্য সংস্থা প্রকাশিত বৈশ্বিক উদারতা সূচকে ২০১৩ ও ২০১৯ সালে মিয়ানমারের অবস্থান শীর্ষস্থানের কাছাকাছি ছিল। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির ‘গভীর কর্মময় মানসিকতাকে’ কল্যাণের প্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এটি অংশত মিয়ানমারে থেরবাদ বৌদ্ধ মতের জোরালো প্রভাবের প্রতিফলন। এই মতের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, আপনি এই জীবনে যা করবেন, তার পরিণতি পরবর্তী সময়ে ভোগ করতে হবে। আর এই বিশ্বাসের মূল উৎস হিসেবেই কাজ করেন ভিক্ষুরা।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি সাধারণ অনুশাসন হলো—‘সংসার’। বৌদ্ধ ধর্মমত অনুসারে সংস্কৃত বা পালি ভাষার এই শব্দের অর্থ হলো—মানুষের অনন্ত জীবনচক্র। বৌদ্ধধর্মে সংসার হল— দুর্ভোগ-ভারাক্রান্ত জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের ক্রমাগত চক্র, যার কোনো শুরু বা শেষ নেই। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা সাধারণত জীবনে পাঁচটি মূলমন্ত্র অনুসরণ করেন। সেগুলো হলো—হত্যা, চুরি, অবৈধ যৌনাচার, মিথ্যা ও মাদক ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, ভিক্ষু ও মঠে দান করার মাধ্যমে পূণ্য অর্জন করা এবং ভালো কাজের মাধ্যমে উপযোগী পুনর্জন্মের আশা করা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দানের উদ্দেশ্য পুনর্জন্ম লাভ হলেও এখন তার সুফল পাচ্ছেন কেবল সীতাগু সায়াদাওয়ের মতো ভিক্ষুরা; সাধারণ ভিক্ষুদের তাতে তেমন উপকার হচ্ছে না। জান্তার মদদে এসব দানে মার্সিডিজ, লিঙ্কনস ও বেন্টলিসহ বিলাসবহুল গাড়িবহরের মালিক হচ্ছেন উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রভাবশালী এই ভিক্ষুরা।
মিয়ানমারের মঠগুলোর আশপাশের সামগ্রিক ‘অর্থনীতির’ ব্যাপ্তি ঠিক কতটা তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা যেতে পারে, দেশটির মঠগুলো ঘিরে বছরে কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলারের লেনদেন হয়। এর সুবাদে ভিক্ষুদের ভাগ্যের চাকা দারুণভাবে ঘুরে গেলেও দেশটির ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। তারপরও এই ধর্মভীরু সাধারণ মানুষেরাই মিয়ানমারের মঠগুলোতে ভিড় জমান; তাঁরা সেখানে দান করছেন এবং ভিক্ষুদের লোভের বৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢেলে চলছেন।
কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম খাওসোদের বার্মিজ সংস্করণে থাইল্যান্ডের এক ভিক্ষুকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি ভক্তের কাছ থেকে দান হিসেবে ২ লাখ ডলার মূল্যের একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার নিয়েছেন। সেই খবর প্রকাশের পর মিয়ানমারের পাঠকেরা মজা করে বলেছিলেন, এই গল্প তাদের জন্য নতুন কিছু নয়, বরং হাস্যকর। কারণ, মিয়ানমারের ‘তারকা ভিক্ষুদের’ কাছে এসব বিএমডব্লিউ হাসির খোরাক। কারণ, এর চেয়ে দামি ও বিলাশবহুল অনেক গাড়ি তাঁদের আছে।
কিন্তু সবসময় এমন বাস্তবতা ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে ২১ শতকের শুরু অবধি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মিয়ানমারের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। সময় বদলে এখন ভিক্ষুরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, সুবিধায় আক্রান্ত হয়েছেন। কারণ, জান্তাবিরোধী ভিক্ষুদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, নইলে তাদের সমাজচ্যুত করা হয়েছে। কেবল যারা যারা সক্রিয়ভাবে জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন বা কেবল নিরপেক্ষ থাকেন, তাদেরকেই অবাধে টিকে থাকতে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে জান্তা সরকার।