লোকসভা নির্বাচনে সত্যিই ম্যাজিক দেখালো রাজ্যটি
‘পশ্চিমবঙ্গে ম্যাজিক দেখাবে বিজেপি’, দাবি করেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লোকসভা নির্বাচনে সত্যিই ম্যাজিক দেখালো রাজ্যটি। শুধু ফলটা হলো নেতিবাচক। বুথফেরত জরিপকে ভুল প্রমাণ করে ঝড় তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতার দলের দাপটে বিজেপির ঝুলিতে থাকতে চলেছে মাত্র ১০টি আসন। কিন্তু কেন? রাজনীতির খেলায় কোন ভুল চালে পশ্চিমবঙ্গে ধাক্কা খেলো বিজেপি?
নির্বাচনের মৌসুমজুড়ে বারবার পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডারা। ঝড় তুলেছেন প্রচারে। রোড শো করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। গত নির্বাচনের চেয়েও এবার কম আসন পেতে চলেছে বিজেপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলটির এমন বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
মমতার জনমুখী প্রকল্প: জনগণের কথা ভেবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী থেকে শুরু করে স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড, সমুদ্রসাথী- একের পর এক জনকল্যাণকর প্রকল্প এনেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জী। সম্প্রতি লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মাসিক ভাতা বেড়ে হয়েছে এক হাজার রুপি, জনজাতিদের জন্য ১ হাজার ২০০ রুপি। আর তাতেই বাজিমাত!
পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা: ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনার মতো একের পর এক প্রকল্পে টাকা আটকানোর অভিযোগ উঠেছে মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে। বিজেপির অভিযোগ ছিল, রাজ্য সরকার টাকার হিসাব দেয় না। তাই কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। কিন্তু সেই ইস্যুকেই বিজেপির বিরুদ্ধে কাজে লাগায় তৃণমূল। দাবি করে, রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গকে ভাতে মারার চেষ্টা করছেন মোদী-শাহরা। হাতিয়ার হয় শুভেন্দু-সুকান্তদের মন্তব্যও। এই বঞ্চনা মেনে নিতে পারেনি রাজ্যবাসী, ভোটবাক্সে তা স্পষ্টতই দৃশ্যমান।
দুর্নীতি অস্ত্র ভোঁতা: ‘চাকরি চুরি’, ‘রেশন চুরি’র মতো স্লোগান তুলেও ভোট বৈতরণী পার করতে ব্যর্থ বিজেপি। দুর্নীতিকাণ্ডে উদ্ধার হওয়া টাকা ভোটারদের ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির অভিযোগে বারবার তৃণমূলকে বিদ্ধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভিজলো না। কার্যত মুখথুবড়ে পড়লো তাদের সেই প্রচার।
বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব: ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিকে ধরাশায়ী করেছিল গেরুয়া শিবিরের অন্তর্দ্বন্দ্ব। দিলীপ ঘোষ-সুকান্ত মজুমদার-শুভেন্দু অধিকারীদের আলাদা আলাদা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তৃণমূল থেকে আসা বহু নেতা-নেত্রীকে গুরুত্ব দেওয়ায় ক্ষোভ বেড়েছিল। রাজ্যস্তর থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল এই দ্বন্দ্ব। নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন পুরোনো কর্মীরা। এ বছরের লোকসভা ভোটেও এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খেসারত দিলো বিজেপি।
অশালীন আক্রমণ: ২১’র ভোটে মমতা ব্যানার্জীকে ব্যক্তিগত আক্রমণের খেসারত দিয়েছিলেন মোদী-শাহরা। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার গেরুয়া শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্ব সেই ‘ভুল’ থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু দিলীপ ঘোষ, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, অসীম সরকারের মতো নেতারা লাগাতার লাগামহীন মন্তব্য করে গেছেন। কুৎসিত ভাষায় মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন। কখনো মমতার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন, কখনো তার পরিবার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এগুলো মোটেও ভালো চোখে দেখেনি রুচিশীল বাঙালি। ভোটবাক্সে যার জবাব দিয়েছেন ভোটাররা।
মেরুকরণ প্রত্যাখ্যান: পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনসভায় দাঁড়িয়ে মোদী-শাহরা বারবার ‘ইসলামফোবিয়া’ তৈরির চেষ্টা করেছেন। মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়েছেন। দাবি করেছেন, তৃণমূল বা কংগ্রেস জিতলে রাজ্যের হিন্দুরা কোণঠাসা হবে। কিন্তু সে কথা কানে তোলেনি বঙ্গবাসী। তাই হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ভোটাররা।
বুমেরাং হয়েছে সন্দেশখালি: গ্রামবাসীর জমি, ভেড়ি দখল থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে নারীদের তুলে নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল। সেই ঘটনা নিয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা ভারতে চর্চা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে বেশি শব্দ খরচ করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। তবে দৃঢ়ভাবেই তারা দাবি করেছিল, যেসব অভিযোগ উঠেছে তার সবটা সত্য নয়। অথচ প্রতিটি প্রচারে এটি নিয়ে সরব হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সন্দেশখালির বেলুন যত ফোলানো হচ্ছে, তাতে ততটা হাওয়া নেই। তাই এই ইস্যুটি কার্যত বুমেরাং হয়ে ওঠে বিজেপির জন্য।
সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন