যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ঋষি সুনাকের উত্থান যেভাবে
যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির নেতা এবং একইসঙ্গে দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। এ ঘটনাকে ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি বাঁক বদলকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কেননা, এই প্রথম একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসীর সন্তান, একজন অশ্বেতাঙ্গ দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ পদে বসছেন।
ঋষি সুনাকের মা-বাবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও তারা থাকতেন পূর্ব আফ্রিকায়। সেখান থেকেই তারা ব্রিটেনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। ঋষি সুনাকের জন্ম ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডের বন্দরনগরী সাদাম্পটনে। তার বাবা সেখানে চিকিৎসক ছিলেন। মা একটি ফার্মেসি চালাতেন। ফলে পরিবার ছিল বেশ সচ্ছল। নামকরা প্রাইভেট স্কুল উইনচেস্টার কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। গ্র্যাজুয়েশন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় ভারতীয় ধনকুবের এবং আইটি সেবা কোম্পানি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতার সঙ্গে। তারপর প্রেম এবং পরিণয়। দুই কন্যা সন্তান রয়েছে এই দম্পতির।
২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাকসে চাকরি করেছেন ঋষি সুনাক। পরে দুইটি হেজ ফান্ডের অংশীদার ছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে প্রথম উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টির রিচমন্ড এলাকার এমপি হন ঋষি সুনাক। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনকে বের করে আনার পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। ব্রেক্সিট গণভোটের প্রচারণার সময় পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন ‘আরও মুক্ত, আরও সমৃদ্ধ দেশ হবে।’
সে সময় তিনি শক্ত অভিবাসন নীতির পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যদিও আমি বিশ্বাস করি, যথাযথ অভিবাসন নীতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু সীমান্ত আমাদেরকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
থেরেসা মে-র সরকারে ঋষি সুনাক স্থানীয় সরকার বিভাগে জুনিয়র মন্ত্রী হন। পরে বরিস জনসন ক্ষমতা নেওয়ার পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিফ সেক্রেটারি নিয়োগ করেন। বরিস জনসনের সঙ্গে মনোমালিন্য তৈরি হওয়ায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করলে অর্থমন্ত্রী হন ঋষি সুনাক। কিন্তু ২০২২ সালে কোভিড লকডাউন ভেঙ্গে পার্টি করা এবং তা নিয়ে মিথ্যা বলার অভিযোগে প্রচণ্ড চাপে বরিস জনসন যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন ঋষি সুনাক।
অনেকে মনে করেন, তার পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বরিস জনসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। বরিস সমর্থকরা তার বিরুদ্ধে সুযোগ-সন্ধানী আচরণের অভিযোগ আনলেও সুনাক বলেছিলেন, নৈতিক কারণে সে সময়ে তিনি সরে গিয়েছিলেন।
বরিস জনসনের পদত্যাগের পরপরই নেতৃত্বের নির্বাচনে প্রার্থী হন ঋষি সুনাক। প্রচারণায় তিনি নিজেকে চৌকস একজন আর্থিক ব্যবস্থাপক হিসেবে তুলে ধরেন। তার প্রচারণার প্রধান বার্তা ছিল – কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ব্রিটিশ অর্থনীতি ভীষণ সংকটে এবং তার প্রধান কাজ হবে এর সমাধান করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের ভোটে তিনি লিজ ট্রাসের কাছে হেরে যান।
সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে আর্থিক খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় দলের ভেতর প্রচণ্ড চাপে পড়ে গত সপ্তাহে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। এর পরপরই আবারও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের জন্য নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন ঋষি সুনাক। শেষ পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি দলের নেতা নির্বাচিত হন।
মাত্র ৪২ বছরের মি. সুনাক হবেন ব্রিটেনের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী এবং ১৮১২ সালের পর থেকে সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।
‘আমি একজন হিন্দু’
ঋষি সুনাক ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেছিলেন, আত্মপরিচয় তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায়, ‘আমার বাবা-মা এদেশে এসে বসতি গাড়েন। সুতরাং এমন একটি প্রজন্ম এদেশে রয়েছে যাদের জন্ম এদেশে হলেও তাদের বাবা-মার জন্ম অন্যত্র। আমার সাংস্কৃতিক প্রতিপালনের কথা যদি বলি, তাহলে সপ্তাহ শেষে শনিবার আমি মন্দিরে গেছি। আমি একজন হিন্দু – কিন্তু একইসঙ্গে আমি সেন্টস্-এর (সাদাম্পটন ফুটবল ক্লাব) ম্যাচের দিন মাঠে গেছি। দুটো কাজই করেছি। সবই করেছি।’
ওই একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি সৌভাগ্যবান ছিলেন যে, বড় হওয়ার সময় তাকে খুব একটা বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু একটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেন যেটি তিনি কখনই ভুলতে পারেননি।
ঋষি সুনাকের ভাষায়, ‘ছোট ভাই ও বোনকে নিয়ে একদিন বেরিয়েছি। অল্প বয়স তখন, বছর ১৫ হবে। আমরা একটি ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। কাছেই কিছু লোক বসেছিল। সেই প্রথম আমাদের লক্ষ্য করে তারা ‘পি’ শব্দটি ছুড়ে দিয়েছিল। ওই শব্দ সেদিন আমার গায়ে ভীষণ লেগেছিল। আমি এখনও তা ভুলিনি।’ তবে একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখনকার ব্রিটেনে এমনটা ঘটবে আমি বিশ্বাস করি না।’
ঋষি সুনাককে নিয়ে বিতর্ক
মনে করা হয় ব্রিটিশ এমপিদের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন ধনী ব্যক্তি। বিভিন্ন সময়ে তার দলের ভেতর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রাইভেট স্কুলে পড়া এবং কোটিপতি ঋষি সুনাক অর্থনৈতিক সংকটে পড়া সাধারণ মানুষের দুর্দশা কতটা অনুধাবন করেন। গত মে মাসে সুনাক এবং তার স্ত্রীর কর দেওয়ার হিসাব নিয়ে বিতর্ক উঠে। চাপের মধ্যে তার স্ত্রী বলতে বাধ্য হন, বিদেশে করা আয় থেকেও তিনি ব্রিটেনে কর দেবেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।