রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে হবে মিয়ানমারকে, সেনাবাহিনী যেন গণহত্যা না চালায়

0

রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে মিয়ানমারকে চারটি অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। আদেশে মিয়ানমারকে বলা হয়েছে, দেশটিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে হবে; সেনাবাহিনী কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য কোনো বাহিনী যেন রোহিঙ্গাদের ওপর  গণহত্যা না চালায় তা নিশ্চিত করতে হবে; দেশটিতে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না; অন্তবর্তীকালীন নির্দেশনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। এরপর থেকে চূড়ান্ত রায় না দেয়া পর্যন্ত ছয় মাস অন্তর অন্তর একটি করে প্রতিবেদন দিতে হবে দেশটিকে।
গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গাদের নৃশংস নির্যাতনের বিরুদ্ধে এটাই আন্তর্জাতিক কোনো আদালতের দেয়া প্রথম রায়।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ৩টার দিকে এই আদেশ পড়ে শোনান আইসিজের প্রেসিডেন্ট বিচারক আব্দুলকাওয়ি আহমেদ ইউসুফ। তিনি জানান, আদালত সর্বসম্মতভাবে এই আদেশ জারি করেছেন। বলেন, আদালতের মতামত হচ্ছে, মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গারা এখনো হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। মিয়ানমারকে সর্বসাকুল্যে তাদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে হবে।

এই আদেশ মানতে মিয়ানমার বাধ্য।

আইসিজের নির্দেশটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিশাল জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান চালায় সামরিক বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্নিসংযোগ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ ও সংগঠন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওই অভিযানে জাতিনিধন ও গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। তবে মিয়ানমার নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার পরও অভিযোগ অস্বীকার করে। গত বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। গত মাসে আদালতে মামলার তিন দিনব্যাপী শুনানি হয়। শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে লড়েন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি।

বৃহস্পতিবার দেয়া আইসিজের রায়ে মামলার বিচারকার্য কয়েক বছর ধরে চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। ডিসেম্বরের শুনানিতে গাম্বিয়া জানায়, মিয়ানমারে এখনো গণহত্যা চলছে। তা বন্ধে অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করতে আবেদন জানায় তারা। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই বৃহস্পতিবার আইসিজের ১৭ বিচারক সর্বসম্মতভাবে এ নির্দেশগুলো জারি করেছেন।

নির্দেশ: বৃহস্পতিবারের রায় নিয়ে আইসিজের প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার্থে মিয়ানমারকে চারটি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে, জাতিসংঘের গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি সম্পর্কিত সনদের ২য় ধারায় বর্ণিত সকল কর্মকাণ্ড থেকে মিয়ানমারে বাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষার্থে দেশটিকে তাদের ক্ষমতায় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে সম্প্রদায়টির কোনো সদস্যকে হত্যা; তাদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন করা; ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের সম্পূর্ণ বা আংশিক শারীরিক ধ্বংসের জন্য তাদের জীবনযাপনের অবস্থার ওপর চাপ প্রয়োগ ও শিশু জন্মদানে সম্প্রদায়টির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারকে তাদের সামরিক বাহিনী, সামরিক বাহিনী সমর্থিত, নির্দেশপ্রাপ্ত অন্য কোনো সশস্ত্র ইউনিট ও বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণে, নির্দেশনায় বা প্রভাবে থাকা কোনো প্রতিষ্ঠান যেন এখন থেকে দেশটিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রথম নির্দেশে বর্ণিত কোনো কর্মকাণ্ড না চালাতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া জনগোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে তারা যেন সরাসরি বা প্রকাশ্যে গণহত্যা চালানোর ষড়যন্ত্র, গণহত্যার উস্কানি ও চেষ্টা না করে তাও নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, মিয়ানমারকে জাতিসংঘের গণহত্যা সনদের দ্বিতীয় ধারায় বর্ণিত সকল অভিযুক্ত কর্মকাণ্ডের প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে ও সেগুলোকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

চতুর্থত, এই আদেশ কার্যকরের সময় থেকে পরবর্তী চার মাসের মধ্যে পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন সম্পর্কে মিয়ানমারকে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর এই মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত একটি করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

মিয়ানমারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান: গত মাসে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সুচির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের আইনজীবীরা দাবি করেন, আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার নেই। বৃহসপতিবারের রায়ে আইসিজে মিয়ানমারের এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে, গাম্বিয়ার এই মামলা করার অধিকার রয়েছে। রায়ে বলা হয়, জাতিসংঘ গণহত্যা সনদটি কোনো সদস্য রাষ্ট্রের জাতীয়, আদিবাসী, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে গণহত্যা বা সনদের তৃতীয় ধারায় বর্ণিত অপরাধ থেকে রক্ষার জন্য তৈরি। আদালতের দৃষ্টিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সনদের আওতায় একটি ‘সুরক্ষিত গোষ্ঠী’। আদালত জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন ও সাধারণ অধিবেশনের প্রতিবেদনের তথ্য টেনে বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার রয়েছে।

এদিকে দু’দিন আগে মঙ্গলবার মিয়ানমার সরকারের এক স্বাধীন কমিশন জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। তবে গণহত্যার পরিকল্পনা বা গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কমিশনের প্রতিবেদনটি বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছে।

রায়ের পক্ষে সমর্থন: বিশ্বজুড়ে প্রভাবশালী নেতা ও অধিকারকর্মীরা আইসিজের রায়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। মামলাকারী দেশ গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী মারি তামবাদু বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ অবসানে এটা ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, তবে এর গুরুত্ব অনেক। তাদের সুরক্ষায় এখন বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।

রায়টিকে স্বাগত জানিয়ে, দ্য হেগে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত আব্দুল আজিজ আবু হামেদ বলেছেন, এটি রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় একটি বড় অগ্রগতি। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সহযোগী আন্তর্জাতিক বিচার পরিচালক পরম-প্রীত সিং বলেন, আইসিজের রায়টি বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা কমানোর পথে একটি মাইলফলক। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন সরকার ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে এখন নিশ্চিত করতে হবে যে, গণহত্যার মামলাটি যেন এগিয়ে যায়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com