মিসরে হিজাব পরে নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার নারীরা

0

মিসরে যে নারীরা হিজাব পরেন, তারা নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে বিবিসি নিউজ অ্যারাবিকের একটি অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

এই প্রবণতা মিসরের সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। যেখানে ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ বা সামাজিক অবস্থান দেখে কোনোরকম বৈষম্য করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মিসরের নারীরা ২০১৫ সাল থেকে সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করছেন যে, হিজাব পরার কারণে তারা এরকম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

এমন একজন কায়রোর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২৫ বছর বয়সী নির্বাহী কর্মকর্তা মায়ার ওমর। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি দামী রেস্তোরায় খেতে গিয়ে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন।

তিনি বলেন, আপনি হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে গেলেন, কিন্তু কেউ আপনাকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না, তখন আপনার একাকী মনে হবে। অথবা আপনার হয়তো মনে হতে শুরু করবে যে, আপনি বন্ধু বা অন্যদের সমস্যায় ফেলেছেন।

সামাজিক মাধ্যমে হিজাব বিষয়ক একটি গ্রুপের মাধ্যমে বিবিসি অ্যারাবিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিজাব পরার কারণে মিসরের নারীরা সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হিজাব পরার কারণে তাদের অনেক স্থানে ঢুকতে দেয়া হয়নি।

আইনজীবী এবং নারী অধিকার কর্মী নাদা নাশাত বলেন, অনেক ক্ষেত্রে মূল কারণ হলোশ্রেণি বিভাজন করে ফেলা। যেসব অনুষ্ঠানস্থলে হিজাবি নারীদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না, এসসব জায়গায় তারা নিজেদের উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ বিত্ত হিসাবে উপস্থাপন করতে চায়। তবে হিজাব পরে না এমন নিম্নবিত্ত নারীরাও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

কায়রোয় যেসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হিজাব পরা নারীদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে, এরকম ১৫টি কেন্দ্রে বুকিং দেয়ার চেষ্টা করেছিল বিবিসি অ্যারাবিক। বেশিরভাগ কেন্দ্র থেকে অতিথিদের সামাজিক মাধ্যম প্রোফাইলের তথ্য চাওয়া হয়েছে। ১১টি প্রতিষ্ঠান থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মাথা ঢেকে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।

বিবিসি অ্যারাবিকের পক্ষ থেকে হিজাব পরা এক দম্পতিকে গোপনে এসব কেন্দ্রে পাঠানো হয়। যামালেক এলাকায় এলঅবারজিন নামে এক রেস্তোরাঁর দারোয়ান ঢোকার মুখেই সাফ জানিয়ে দেন, মাথায় হিজাব পরে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না। কারণ ভেতরে একটি মদের দোকান রয়েছে, ফলে হিজাব পরা কোনো নারীকে সেখানে যেতে দেয়া হয় না। এমনকি ম্যানেজার এসে জানিয়ে দেন, এখানে মাথায় কাপড় দেয়া নিষিদ্ধ।

পরে এসব আলাপের রেকর্ডিং যখন তাদের শুনানো হয়, এলঅবারজিন দাবি করে, এটি পুরোপুরি সত্য না। হিজাব পরা নারীদের প্রবেশ করতে না দেয়ার কোনো নীতি তাদের প্রতিষ্ঠানের নেই। তবে তারা বলেছে, আমরা এটিকে নিরুৎসাহিত করি।

প্রতিষ্ঠানটি বিবিসিকে বলেছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নীতি সম্পর্কে কর্মীদের ভালোভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।

ওই এলাকার আরেকটি রেস্তোরা কাজানেও প্রবেশ করতে গেলে সেখানেও তাদের আটকে দেয় দারোয়ান। তিনি সরাসরি বলে দেন, সমস্যা হলো আপনার মাথার কাপড়। কেন? জানতে চাইলে উত্তর আসে, এটাই প্রতিষ্ঠানের নীতি।

হেলিওপোলিসের একটি রেস্তোরা, আন্দিয়ামোয় প্রথমে এই দম্পতিকে ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। পরে ম্যানেজারের সাথে এ নিয়ে কথা হলে, তিনি শর্ত দিয়ে বলেন, তারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, তবে একটি কোনায় তাদের বসে থাকতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায়, বার এলাকায় কোনো হিজাবি নারীকে দেখতে পেলে জরিমানা করা হয়।

তবে এই বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে কাজান বা আন্দিয়ামো কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

মিসরের পর্যটন ও রেস্তোরা সমিতির চেয়ারম্যান আদেল আল মাসরির কাছে এসব তথ্য প্রমাণ দেখিয়েছিল বিবিসি অ্যারাবিক।

তিনি বলেন, পর্যটন মন্ত্রণালয়ে কোনো সময়েই বোরকা বা হিজাব পরা নারীদের (অবকাশ কেন্দ্রে) প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো ধরনের বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য।

অনুসন্ধানে অ্যারাবিক আরো জানতে পারে, হিজাব পরা নারীদের কাছে অবকাশকালীন অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে না সেদেশের একটি বড় আবাসন কোম্পানি লা ভিস্তা। কায়রো ও উপকূলীয় বেশ কয়েকটি শহরে এই কোম্পানির প্রকল্প রয়েছে।

অতীতে যদিও তারা হিজাবি নারীদের কাছে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করেছে। কিন্তু বিবিসি দেখতে পেয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই লা ভিস্তাকে তাদের নীতি বদলানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একজন নারী নির্বাহী অ্যারাবিককে বলেন, লা ভিস্তায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে বেশ কয়েকটি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তারা বলেছে, হিজাব পরা কারোর লা ভিস্তায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা বেশ কঠিন।

একজন ক্রেতা সেজে বিবিসি অ্যারাবিক ছয়টি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যাতে তারা লা ভিস্তার একটি উপকূলীয় প্রজেক্টে অ্যাপার্টমেন্ট কিনে দিতে পারে। এই ক্রেতার স্ত্রী একজন হিজাব পরা নারী, এভাবে তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সবগুলো প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, লা ভিস্তায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব নয়।

একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিবিসির ছদ্মবেশী প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনাকে খোলাখুলিভাবে বলছি, আপনাদের বিকল্প কিছু দেখা উচিত।’ আরেকজন বলেন, ‘উত্তর উপকূল আর সোকনার প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে, তারা বেশ বৈষম্য করে থাকে।’

একজন মধ্যস্থতাকারী পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেন। ‘তারা বলবে না যে, এই প্রকল্প আপনার কাছে বিক্রি করা হবে না। তারা বলবে, আপনি যে প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চাইছেন, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। যখন সেটা আবার চালু হবে, আমরা আপনাকে ফোন করবো। আর সেটা কখনোই ঘটবে না।’

যখন বিবিসির ছদ্মবেশী সংবাদদাতা লা ভিস্তায় ফোন করেন এবং জানান যে, তার স্ত্রী নিয়মিত হিজাব পরেন, তখন তাকে বলা হয় যে, কোন প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট খালি নেই, তাকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হচ্ছে।

এর বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে লা ভিস্তা কার্যালয়ে যান। এবার তিনি স্ত্রীর হিজাব পরার বিষয়ে কিছু বলেননি। তাকে সাথে সাথেই জানানো হয় যে, বিক্রির জন্য তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ইউনিট খালি আছে।

সেখানে কি ধরনের মানুষ বসবাস করেন, জানতে চাওয়া হলে কোম্পানির এজেন্ট বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা হলো, সেখানে বসবাসকারী সবাই বেশভূষায় যেন একই রকমের হন। লা ভিস্তার কোনো প্রকল্পেই বোরকা পরা কোনো নারী থাকেন না।’

এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে লা ভিস্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও এখনো তাদের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন, মিশরীয় সংসদ সদস্য আমিরা সাবের বলেন, মিশরের সংবিধানে পরিষ্কার করে বলে দেয়া আছে, এরকম বৈষম্য কারো সাথে করা যাবে না।

তিনি বলেন, ‘আমার পার্লামেন্টারি ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আমি জানতে চাইবো, কিভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যায়। এরপরও যদি তা ঘটে, তাহলে অবশ্যই দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হবে।’

সূত্র : বিবিসি

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com