ওমানের নেপথ্য কলকাঠি
বিশ্বজুড়ে নানা দেশে যখন দীর্ঘস্থায়ী শাসকদের স্বৈরাচারী, একনায়ক আখ্যা দিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হচ্ছে, তখন বেশ নীরবেই শাসনের সূবর্ণজয়ন্তী পূর্ণ করে বেশ নিভৃতেই এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। ওমানের সাবেক সুলতান কাবুস বিন সাঈদের কথাই বলা হচ্ছিল। মাত্র ২৯ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পিতা সাঈদ বিন তাইমুরকে সরিয়ে সুলতান হয়ে বসেন কাবুস। তবে ওমানের সে মুহূর্তের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। দেশটিতে তখন উল্লেখ করার মতো অবকাঠামো বলতে ছিল ১০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও তিনটি স্কুল। জেলেদের দেশ হিসেবে পরিচিত এই দেশটি গত ৫০ বছরে কাবুসের পরিচালনায় হয়ে উঠে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র।
উদারমনা ও উচ্চশিক্ষিত হিসেবে পরিচিত কাবুস ক্ষমতায় বসার পরপরই মনোযোগ দেন নিজেদের তেলসম্পদ কজে লাগানোর দিকে। তা দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলেন তিনি। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ওমানকে প্রায় অবকাঠামোহীন দেশ থেকে একটি আধুনিক দেশে রূপান্তর করেছেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সুখী ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ওমান।
কাবুস অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন করেছেন, তেমনি দেশের পুরোনো অনেক রীতিনীতিও পাল্টে দেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদ করেন। রক্ষণশীল বৃত্ত ভেঙে জনগণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেন তিনি। আবার নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি রচনা করেন নতুন এক ধারার।
ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি আজীবন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে যুক্তরাজ্যকে সবকিছুতে প্রাধান্য দিয়েছেন। আবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো লোকদেরও নিমন্ত্রণ জানিয়ে দেশে নিয়ে আসেন তিনি। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সুলতান কাবুস পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিলেন নিরপেক্ষ নীতি। নিজের রচিত পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি লিখেছিলেন, তার দেশ ব্রিটেনের প্রতি অনুরাগী। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর মেজবান হতে আগ্রহী আবার ইরানের আয়াতুল্লাহ ও চীনের ব্যবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করেও তারা খুশি। এ ধরনের পররাষ্ট্রনীতির কারণে সমালোচনার মুখে পড়লেও এর কারণেই তিনি বিশ্ব রাজনীতির কঠিন ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্যের মতো জটিল জায়গাতেও নিজের অন্য ধরনের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবার তার কূটনৈতিক দক্ষতাও ছিল ঈর্ষণীয়। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক বড় বড় ইস্যুতে তার কূটনৈতিক তৎপরতা পেয়েছে বড় ধরনের সফলতা। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্র নিরোধ চুক্তি কিংবা ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ করার পেছনে তার অবদান ছিল অসামান্য।
বর্তমানে আবার ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে অনেকে অনুভব করছেন কাবুসের শূন্যতা। কিন্তু তার এসব অবদানকে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই ভালবাসতেন। সে কারণে বিশ্ববাসীর কাছে সেসব খবর তেমনভাবে পৌঁছত না। কিন্তু বিশ্ব নেতাদের কাছে তার মূল্যায়ন ছিল বেশ উচ্চ পর্যায়ের। আবার দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও তাকে বেশ সফলই বলা চলে। কারণ তিনি ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সাহায্য নিয়ে ওমানের দক্ষিণাঞ্চলে উপজাতিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন করেন। আবার ২০১১ সালে আরব বসন্তের তোড়ে যেখানে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো এশিয়াই শাসকগোষ্ঠীর জন্য জাহান্নাম হয়ে উঠেছিল, সে সঙ্গিন মুহূর্তেও তিনি সে চাপ সামাল দিয়েছেন বেশ ভালোভাবেই। সব মিলিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত থেকেই এ দুনিয়া ছেড়ে যান ১৯৪০ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করা কাবুস বিন সাঈদ।
সুলতান কাবুস মারা গেছেন গত ১০ জানুয়ারি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সরকারব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্র খুব জোরালো থাকলেও কাবুসের কোনো সন্তান বা ভাই না থাকায় সরাসরি পরিবারতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা কার্যকরের কোনো সুযোগ ছিল না ওমানে। তবে ক্ষমতা একেবারে গোষ্ঠীর বাইরেও চলে যায়নি। কারণ নতুন সুলতানের তালিকায় ছিলেন কাবুসের তিন চাচাতো ভাই ওমানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী হাইতাম বিন তারিক তৈমুর আল-সাঈদ, উপপ্রধানমন্ত্রী তারিক আল সাঈদ ও সাবেক নৌকমান্ডার সিহাব বিন তারিক আল সাঈদ।
ওমানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশটিতে তিন দিনের বেশি সুলতান পদ খালি রাখার নিয়ম নেই। কাবুস মৃত্যুর অনেক আগেই তার উত্তরসূরি নির্বাচন করে একটি চিঠি লিখে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরই সে চিঠিটি খোলা হয়েছিল। তাতেই হাইতাম বিন তারিককে সুলতান হিসেবে মনোনীত করার নির্দেশনা পাওয়া যায়। মরহুম সুলতানের সে নির্দেশনার বিরোধিতা করেনি কেউই। নতুন সুলতান হিসেবে শপথ নেয়া হাইতাম নানা সময়ে সুলতান কাবুসের বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৯৪ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত একই মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ক্রীড়ামোদি এই শাসক আশির দশকের শুরুতে ওমান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম প্রধান নির্বাহী। ওমানের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প ‘ওমান ২০৪০’ বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
ওমানে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সুলতানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। ওমানের সুলতান একই সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার এবং প্রতিরক্ষা, অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
নতুন সুলতান হাইতাম দায়িত্ব নেয়ার পর তার প্রথম ভাষণে বলেছেন, তিনি তার পূর্বসূরির ধারাই চালু রাখবেন। কারণ ওমানের লোকজন এই পররাষ্ট্রনীতিতেই খুশি। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সঙ্ঘাত থেকে দূরে থাকা এবং বিভিন্ন সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার ভূমিকায় তারা গর্বিত। হাইতাম আরো বলেন, আমরা এখন উপসাগরে নই, আমরা এখন অবস্থান করছি ভারত মহাসাগরে। আমাদের চোখে এখন সবই স্পষ্ট।
তবে পূর্ববর্তী ধারা বজায় রাখার কথা বললেও নতুন সুলতানের সময়ে এসে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাজ্য না যুক্তরাষ্ট্র, নতুন সুলতান কোন পক্ষের দিকে বেশি ঝুঁকবেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন যেমন ওমানের ভূমিকায় খুশি নয়, তেমনি ওমানও ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর সন্তুষ্ট নয়। তবে কাবুসের আমলেও যুক্তরাষ্ট্র ওমানে যতটুকু সুবিধা পেয়েছে তার সবকিছুতেই ছিল বর্তমান সুলতান হাইতামের অবদান। হাইতাম দীর্ঘ সময় ধরে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার বেশ সদ্ভাব ছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে ওমানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে দেয়া বা সেখানে মার্কিন সামরিক জিনিসপত্র স্থাপনের আলোচনায় সাহায্য করেছিলেন সুলতান হাইতাম।
ওমানের বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতির কারণে অবশ্য তার প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দেশটির ওপর ক্ষুব্ধ। কারণ ইয়েমেনের যুদ্ধে সুলতান কাবুসের নিরপেক্ষতা, কাতারের অবরোধ ও ইরানের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওমানের অবস্থান সৌদি জোটের তেমন একটা পছন্দ নয়। অনেকে তো আশঙ্কা করেছিলেন, ওমানের অবস্থাও কাতারের মতো হতে পারে। অবশ্য সে আশঙ্কা কাবুস উতরে গিয়েছিলেন, ২০১৮ সালে ভারত মহাসাগরে ব্রিটেনের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে। বিষয়টিকে তখন মধ্যপ্রাচ্যের ওইসব দেশকে এ বার্তা দিয়েছিল যে, ওমান শক্তিশালী একটি দেশ, এবং ওমানেরও শক্তিশালী বন্ধু রয়েছে।
এদিকে ওমানে দেশী-বিদেশী ব্যাপক বিনিয়োগ থাকার পরও তেল থেকেই এখনো তাদের আয়ের ৭০ শতাংশ আসে। সাম্প্রতিক সময়ের তেলবাণিজ্যের মন্দায় দেশটিকে ঘাটতি পুরাতে হয় অন্য খাত থেকে। এছাড়া গত বছর বিশ্বব্যাংক দেশটিতে ৪৯ শতাংশ বেকারের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিল। এ দিকগুলো নিয়ে কিছুটা সমস্যায় রয়েছে ওমান। এ অবস্থায় মূল সমস্যা কূটনীতিতে দক্ষ হলেও হাইতামের অর্থবিষয়ক জ্ঞানের গভীরতা কম। তাছাড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায়ও তিনি তেমন পটু নন। এ অবস্থায় ওমানের সার্বিক নীতি কী হয়, বিশেষ করে অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও দেশ পরিচালনার নীতি কেমন হয়, তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন সবাই। তবে সাবেক সুলতানের সময়কাল যেখানে ৫০ বছর ছিল, সেখানে তো নতুন সুলতানকে পরখ করে দেখতে অন্তত পাঁচ বছর সময় তো দরকারই।