রামেক হাসপাতালে ২৫০ দালালের দৌরাত্ম্য, অসহায় রোগীরা

0

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দালালচক্র। তাদের দৌরাত্ম্যে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তার স্বজনরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় রোগীরা দালালদের কথা না শুনলে তাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এছাড়া মাঝে মাঝেই রোগী ও স্বজনদের উপরে প্রকাশ্যে মারধরের ঘটনাও ঘটছে।  দীর্ঘদিন থেকে রোগী-স্বজনদের ব্যাগে থাকা মোবাইল-টাকা পায়সা চুরি হয়ে যাচ্ছে। অনেকে সব হারিয়ে চিকিৎসা না নিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার উপরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে দালালরা। কয়েক সপ্তাহ খোঁজখবর নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। অথচ দালালদের এসব দৌরাত্ম্যে নিরব ভূমিকা পালন করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বরং অভিযোগ আছে, হাসপাতালের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর মদদ ও যোগসাজশে পুরো হাসপাতাল জুড়েই দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে দালালরা।  এদিকে হাসপাতালে কতর্ব্যরত কিছু চিকিৎসক ও কর্মকর্তা প্রতিবাদ করলেও তাদেরকে দেখানো হচ্ছে ভয়ভীতি। ফলে মানসম্মানের ভয়ে তারাও কিছু বলতে পারছে না।  বৃহস্পতিবার হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বহির্বিভাগের পুরো এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দালালরা। সব ওয়ার্ডের সামনে রোগী ও তার স্বজনরা বের হলেই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে কয়েকজন দালাল টানাটানি করছেন। কিন্তু রোগীদের এমন বিড়ম্বনায় পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে দেখছেন কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা। অনেক দালাল প্রকাশ্যেই বলছেন, সবাইকে ম্যানেজ করেই তারা হাসপাতালে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহে সবাইকে টাকার ভাগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় তিনগুণ বেশি রোগী থাকায় চিকিৎসকরা সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে পারছেন না। আর এতো সংখ্যক রোগীর নিরাপত্তা দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। বহির্বিভাগে কয়েক হাজার মানুষের নিরাপত্তায় প্রতিদিন সকালে থাকছে মাত্র ২ জন কনস্টেবল। অন্যদিকে নারীদের জন্য নেই কোনো নারী পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরে এমন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও দু’একদিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি বৃদ্ধি করা হলেও তা হয় মাত্র লোক দেখানো। পরবর্তী সময়ে যেমন অবস্থা থাকে ঠিক তেমন হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় হাসপাতাল থেকে দালাল চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও কয়েকদিনের মাথায় ছাড় পেয়ে আবারো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর মূল হোতা বরাবরের মতই ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে।  এ বিষয়ে রোগীর স্বজন পরিচয়ে কৌশলে কথা হয় একাধিক দালালের সঙ্গে। যারা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিল নগরীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তারা জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মাসোহারা দিয়েই এ কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলাশের মূল নাম ফজলুর রহমান। সম্প্রতি এই পলাশ সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য সংখ্যা ১০৭ থেকে বেড়ে দেড়শ’ জনে ঠেকেছে। এদের মধ্যে রামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে কাজ করে ৭২ জন। যাদের মধ্যে নারী দালালের সংখ্যা ২০ জন। সবাই শতকরা ৫০ শতাংশ কমিশনে কাজ করে। এ কমিশনের টাকা আসে রোগীর কাছ থেকে আদায়কৃত অংশ থেকে। তবে প্রশাসনকে ম্যানেজ করার অজুহাতে প্রতিটি দালালের কাছ থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ টাকা কেটে রাখে সিন্ডিকেট প্রধান পলাশ।  তাদের দেওয়া তথ্য মতে, এই চক্রের দেড়শ’ সদস্যের কাছ থেকেই সিন্ডিকেট প্রধান পলাশের প্রতিদিন অতিরিক্ত আয় ২২ হাজার ৫০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতিমাসে অতিরিক্ত আয় ৬ লাখ ৭৫ হাজার। যার পরিমাণ বছরে গিয়ে হয় ৮১ লাখ টাকা। এদিকে শুধু এই সিন্ডিকেডের ১০৭ জন সদস্য নয়- বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগস্টিক সেন্টারের প্রায় ২৫০ এর মত দালাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাসপাতালে। তথ্যমতে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা তাদের এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধের দোকান ও বেসরকারি হাসপাতালের শেয়ারহোল্ডার বা মার্কেটিং অফিসারের ব্যানারেও এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব দালাল চিকিৎসা নিতে আসা রোগিদের ধরতে বর্হিবিভাগসহ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। রোগীদের ভাল চিকিৎসা দেওয়ার নাম করে সুযোগ বুঝেই তারা তাদের পছন্দমত নিম্নমানের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন হিসাবে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ টাকা পেয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযান বন্ধ রাখা এবং শাস্তি নিশ্চিত না করায় তারা বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে। আর এদের কার্যক্রমে হাসপাতালেরই বিভিন্ন শ্রেণির স্টাফ সহযোগিতা করে থাকে। তবে মাঝে মধ্যে দু’একটি করে চুক্তিহীন দালাল ধরা পড়ে। যাদেরকে দালাল সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকেই ধরিয়ে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। রামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌসও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘দালালদের উৎপাত খুবই বেড়ে গেছে। আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালিয়ে দালালদের ধরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে তুলে দিই। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কারাগার থেকে তারা ঠিকই বের হয়ে আসে। আইন কী তাদের পক্ষে শিথিল কি না বুঝি না। দালালদের দৌরাত্ম্যে বন্ধের বিষয়ে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু পারছি না। দালালদের দৌরাত্ম্য আর রোগীর স্বজনদের ভিড় যদি কমানো যেত তাহলে চিকিৎসাসেবা আরো উন্নত করা সম্ভব হতো।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com