সহনীয় ঘুষে বরণীয় দুর্নীতি

0

কাজটা কী করলো পরিকল্পনা কমিশন? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইউরোপ বা জাপান থেকে দেড় লাখ টাকা দরে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন আনতে বাধ সাধলো। তাদের বাধায় জাপান থেকে এ দামে ৩৬০টি ওয়েস্টবিন আমদানিকর্মটা থেমে গেছে। নানান অভিজ্ঞতার জন্য বিদেশ সফর আর দেশে কয়লা-ময়লা, বালিশ-পর্দা সবখানেই গৌরিসেনের টাকার উৎসবের মধ্যে এমন বাধা না দিলেই বা কী হতো?

বিদেশ সফর, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি, কেনাকাটা, পাচার সব কিছুতে ফ্রিস্টাইলের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের এই বাধ সাধা মোটাদাগের ভিন্ন ঘটনা। ক্ষমতাসীন মহল থেকে বলা হয়েছে এগুলো তেমন কিছু নয়, ছিঁচকে চুরি। এর আগে বলা হয়েছিল নাথিং। ঘুষকে বলা হয়েছিল স্পিডমানি। আবার সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শও ছিল। এ ধরনের আস্কারা-মশকরা, পরামর্শে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, পাচারসহ সব এখন মামুলি। যথারীতি সহনীয়, এমন কি বরণীয়ও হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ চমৎকার। এ নিয়ে কোনো হৈ চৈ নেই।

 সরকারের নিয়মানুযায়ী একজন সচিব বছরে চারবার বিদেশ যেতে পারবেন। অথচ দেশে এক বছরে একজন সচিবের সর্বোচ্চ ৭৫ বার বিদেশযাত্রার রেকর্ডও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের একই সময়ে বিদেশ সফরেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী-সচিবরাও এই নীতিমালা মানছেন না। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদেরও সরকারি টাকায় একাধিকবার বিদেশ সফরের ঘটনাও রয়েছে। 

ঘটনাচক্রে দু’চারটা ঘটনা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ-বেদনায় খবর ফাঁস করেন বঞ্চিতরা। সুযোগ পেলে তারা হয়তো চুপই থাকতেন। তথ্য চালানে বিরত থাকতেন। সেটা না হওয়ায় বিনোদন সংবাদের মতো প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে আলু দেখতে, পুকুর খনন শিখতে, ক্যামেরা বা মোবাইল কিনতে সরকারি টাকায় দল বেঁধে বিদেশ যাওয়ার খবর। প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর ছাড়াও পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে যাচ্ছেতাই কাণ্ড, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ কেনা, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ লাখ টাকায় পর্দা কেনা, গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকার বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুহতারাম ডিজির পবিত্র কুরআন শরীফ না ছেপে টাকা হজম করে দেয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরে তিন কোটি টাকার যন্ত্র ২৫ কোটি টাকায় কেনা বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক আফজলের লোপাটের মতো কিছু খবর ফাঁসের পেছনে এ ধরনের কিছু ব্যাপারসেপার রয়েছে। ভাগযোগে মিলে গেলে এসব খবর কোনোদিনই জানা হতো না।

উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশের দিকে দিকে টাকা। আয়-আয়ুর সঙ্গে টাকারও ছড়াছড়ি। উপচেপড়া টাকা রফতানি হচ্ছে দেশে-দেশে। কানাডাসহ কয়েকটি দেশে এ নিয়ে সরেস খবর। এর বিপরীতে দুর্নীতির বাস্তব উদাহরণ কৌতূকের চেয়েও উদ্ভট। বারবার শেয়ারবাজার লুটের বিচার হয়নি। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটেও তাই। বরং এখন ঋণখেলাপিদের আবার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়া হলমার্ক গ্রুপের দিনকাল খারাপ যাচ্ছে না। তাদের আবার শানমানে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের জন্য সরকারি অনুমতি নিতে হয়। কোন কর্মকর্তা, কোন দেশে, কী কারণে কতদিন অবস্থান করবেন বা করছেন সেটার বিস্তারিত সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানোর বিধান রয়েছে। বেশিরভাগ সফরকারীই এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। প্রশিক্ষণ শেষে সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। সরকারের নিয়মানুযায়ী একজন সচিব বছরে চারবার বিদেশ যেতে পারবেন। অথচ দেশে এক বছরে একজন সচিবের সর্বোচ্চ ৭৫ বার বিদেশযাত্রার রেকর্ডও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের একই সময়ে বিদেশ সফরেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী-সচিবরাও এই নীতিমালা মানছেন না। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদেরও সরকারি টাকায় একাধিকবার বিদেশ সফরের ঘটনাও রয়েছে।

অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে অথবা অন্যান্য অজুহাতে সরকারি কর্মকর্তাদের ফরেন ট্যুর আসলে নতুন নয়। এটা বৈধ-স্বীকৃত। তাদের এক ধরনের পেশাগত অধিকারও। সাধারণত প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনার জন্য কর্মকর্তারা বিদেশে যান। শিক্ষালাভের জন্যও অনেকে বিদেশ যান। আবার অতি সাধারণ কাজেও দলবেঁধে বিদেশ ভ্রমণের ঘটনা রয়েছে। কিন্তু, গত কয়েক বছরে শুধু সরকারি কর্মকর্তা নন, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার-কবিরাজসহ বিভিন্ন সেক্টরের ক্ষমতাধরদের বিদেশ সফরের হার চলে গেছে চরমে। যেন উৎসব-প্রতিযোগিতা। যার কোনো কোনোটি রীতিমত হাস্যকর পর্যায়ে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি বেশি আলোচনার জন্ম দেয় প্রতিযোগী ছাড়াই পুরস্কার আনতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টার ঘটনায়। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসার আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। তাদের পুরস্কৃত করতে নাসার পক্ষ থেকে ফ্লোরিডায় আমন্ত্রণ জানানো হয় দলটিকে। বিজয়ী দলের সদস্যদের সাথে যেতে তথ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কয়েক কর্মকর্তারও ভিসা আবেদন করা হয়। শেষ পর্যন্ত ভিসা জটিলতার কারণে নাসার আমন্ত্রণ পাওয়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলের সদস্যরা কেউ যাওয়ার অনুমতি পায়নি। মজার বিষয় হলো, আসল প্রতিযোগীরা অনুমতি না পেলেও তাদের সহযোগী হিসেবে যাদের যাওয়ার কথা ছিল, সেই সরকারি কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে আসেন সরকারি খরচে।

এ নিয়ে গণমাধ্যমে তখন বেশ রসালো সংবাদ হয়। বিপরীতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা অর্জনের বাহানায় ফাও বিদেশ সফরের ঘটনা আরো বেগবান হয়। পুকুর খনন শিখতে, লিফট কিনতে, নিরাপদ পানি দেখতে, আলু চাষের অভিজ্ঞতা নিতে বিদেশ সফরের খবর মানুষকে ব্যথিত করার পাশাপাশি বেশ বিনোদিতও করছে। অনেকের এমনিতেই ভোলা ব্যারাম। অল্পতেই তারা আগের বিনোদনটা ভুলে যাচ্ছে। পরেরটাও ভুলে যায় কয়েকদিনের মধ্যে। তাই বিনোদন সাপ্লাই একটু দরকারও বৈকি?

সরকারি টাকায় বিদেশ সফরের এমন সুবর্ণ সুযোগ কবে, কখনো, কোথাও ছিল কি-না, বা আর আসবে কি-না- সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে এ সুযোগ রাখা হয়েছে। আর সুযোগ থাকলে সুযোগের অপব্যবহারও প্রাসঙ্গিক। সুযোগ না পাওয়া মানুষ এ নিয়ে হাসি মশকরা করলেই বা কী? কে ঠেকাবে সফরকারীদের? তাজ্জবের বিষয় হলো- কে, কখন, কোন বাহানায়, কতবার বিদেশ ট্রিপ দেন সেটার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সেটা হিসাবে রাখার কোনো আলাদা দফতরও নেই। দিনকে দিন অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে আলাদা মন্ত্রণালয় না হোক অধিদফতর-পরিদফতর কিছিমের কিছু একটা পয়দা করা জরুরি হয়ে পড়ছে। এ ধরনের তামাশাময় বিদেশ সফরে অপচয় হওয়া বিশাল অংকের অর্থটা দেশের। জনগণের।

সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রীর বিরক্তি প্রকাশের খবর আমরা দেখেছি। প্রকল্পের অজুহাতে অহেতুক বিদেশ সফর না করার কঠোর নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু, কে শোনে তার নির্দেশ? নির্দেশ না শুনলে, না মানলে কিচ্ছু হবে না- আলামতে মনে হয় এমন গ্যারান্টি তাদের কবজায়। নইলে কিভাবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হুকুমের পরও আলু চাষ, কারাগার, পুকুর খননের মতো কাজ দেখে অভিজ্ঞতা অর্জনের ছুতায় জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে দল বেঁধে বিদেশ সফরের সাহস মেলে?

দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে নানা ছুতোয় বিদেশ ভ্রমণের এই আশ্চর্য চেরাগের আলোতে আলোকিত হয়ে চলছেন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও। কেউই পিছিয়ে থাকছেন না। বিগত বছরগুলোতে নানা ঘটনায় এমন সব বিদেশ সফর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও কিছুতেই তা কমানো যাচ্ছে না। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এখন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই ওই প্রকল্পের শতাধিক কর্মকর্তার বিদেশ সফরের বাজেট বরাদ্দ অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একদিকে, কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা কেন বা কোন বিষয়ে কী প্রশিক্ষণ নিতে কোন দেশে যাবেন সেসব উল্লেখ করা না হলেও তাদের বিদেশ সফরের জন্য বাজেট বরাদ্দটা আগেই নিশ্চিত করা হচ্ছে।

ফাঁকেফুকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও বিদেশে প্লেজার জার্নি সেরে ফেলছেন নিঃশব্দে। বিদেশে তাদের আরাম-আয়েশ তথা প্রমোদের কিছু তথ্যও প্রকাশ পায়। কিন্তু, সমস্যা হয় না। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বেলারুশ সফর বা দক্ষিণের সিস্টেম অ্যানালিস্টের বিশাল বাজেটে চীন সফর নিয়েও ক’দিন হৈ চৈ হয়েছে। সেটা তাদের পেশাগত দায়িত্বের সঙ্গে সাযুজ্য কি-না, সেই প্রশ্ন বেশিদূর গড়ায়নি। মানুষও এসব ঘটনাকে স্বাভাবিক প্রথা হিসেবে মেনে নিতে এরইমধ্যে বাধ্যগত হয়ে গেছে।

এর মানে এই নয় যে, সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে যাবেন না। অত্যাবশ্যকীয় কাজে, প্রশিক্ষণের জন্য, বিশেষ কোনো বিষয়ে কারিগরি বা ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আহরণে অথবা কোনো কিছু ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার বিষয়টি যৌক্তিক। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে-কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের কতটা সুফল পায় রাষ্ট্র? জানা যায়, কর্মকর্তাদের যথেচ্ছ বিদেশ ভ্রমণের মারাত্মক প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কাজের সুবিধার জন্য উইং রয়েছে। একটি উইং থেকে একজন কর্মকর্তার অনুপস্থিতির কারণে নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো ঝুলে থাকে।

তাছাড়া অনেকে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন যে মন্ত্রণালয়ের জন্য, দেশে ফেরার পর তাদের সেখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ারও নজির আছে। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান সরকারের কোনো কাজে লাগে না। এভাবেই সরকারি অর্থের অপচয় হয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক হাল বাস্তবতায় সরকারি কর্মকর্তাদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নজিরবিহীন। বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপি কিংবা উচ্চ পদস্থ কর্তমকর্তারা অনন্য মানের দক্ষ। তবে, এ দক্ষতা নিতে বা শিখতে বিদেশ থেকে কেউ আসছেন না। অবিশ্বাস্য দামে বালিশ-পর্দা, লোটা-কম্বল কেনার অভিজ্ঞতা নিতে আসছে না কেউ। আসছে না কয়লা-ময়লা খাবলে খাওয়ার তালিম নিতে। ভিসি-ডিসি-ওসি হওয়া বা পুকুর চুরি শিখতেও।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com