শাস্তি কেন শুধুই ৫ পুলিশ কর্মকর্তার?
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘীতে আয়োজিত জনসভায় যাওয়ার পথে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি করে ২৪ জনকে হত্যা মামলার রায় সোমবার ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে তৎকালীন পুলিশের ৫ কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত।
৩২ বছর পরে হলেও একটি্ গণহত্যা মামলার বিচার হয়েছে এটা ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, প্রত্যেকেরই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। অন্যদিকে, যারা হুকুমদাতা বা যাদের নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তাদেরও শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছেন তারা।
দেখা গেছে, ১৯৮৮ সালে সারাদেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। শেখ হাসিনা ওই সময় মাইকে বার বার বলছিলেন, আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা নির্দেশ দিচ্ছি, গুলি চালাবেন না। পুলিশ তার কথায় কোনো পাত্তাই দেয়নি। পুলিশ তাদের উপরের হুকুম অনুযায়ী গুলি চালিয়ে পাখির মতো ২৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে।
এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটার পরও সেদিন আওয়ামী লীগ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কোনো শক্ত কর্মসূচি ঘোষণা দেয়নি। এমনকি ঘটনার পরের দিন ২৫ জানুয়ারি শহীদ মিনারে একটি্ সর্বদলীয় শোকসভার আয়োজন করা হয়। সেই শোক সভাতেও অংশ নেননি শেখ হাসিনা। সেদিন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শোক মিছিল বের হয়েছিল।
স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার শেখ হাসিনার ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারে সেইজন্য তিনি সর্বদলীয় শোকসভায় অংশ নেননি বলে মনে করছেন রাজনীতিক মহল। তারা বলছেন, সে সময় এরশাদের ভয়ে শেখ হাসিনা কোন প্রতিবাদ করতে পারেননি। এখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে ইচ্ছামত রায় দিয়ে দিচ্ছেন। এ সময় তিনি যেভাবে স্বৈরাচারী করে মানুষকে হত্যা করছেন তার বিচারও এক সময় হবে।
এর আগে গতকাল ৪ আসামির সাফাই সাক্ষ্য শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরায় গতি পায়। আদালতের আদেশে মামলাটির তদন্তের ভার পড়ে সিআইডির ওপর। সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। আবারও আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর পুলিশের আট সদস্যকে আসামি করে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
আওয়ামী লীগের আমলেই মামলার দুই বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে, কিন্তু একটি প্রতিবেদনেও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের কাউকে আসামি করা হয়নি। অথচ, সারাদেশ যখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল তখন সরকারের নির্দেশেই শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি চালানো হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক ছিল স্বৈরাচার এরশাদ। এরশাদকে তো দূরের কথা, তার সরকারের কোনো মন্ত্রীকেও আসামি করা হয়নি।
এরশাদ এবং তার সরকারের কাউকে আসামি না করার মূল কারণ ছিল-শেখ হাসিনা ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিল মূলত এরশাদের সমর্থন নিয়ে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতিবাজ এরশাদকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
এরপর, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেও মামলার ঘোষণার আগ পর্যন্ত এই মামলা থেকে এরশাদ ও তার দলের লোকজনকে বাইরে রাখা হয়েছে। এটারও কারণই একই। এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টির কারণেই শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে আছে।
অথচ বিপরীতে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে যে কয়টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সবগুলোর জন্যই শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছে। শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে দেশে যেসব ঘট্না ঘটেছে সব কিছুরই পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত ছিল। কিন্তু, এরশাদ খুনি হলেও ক্ষমতার স্বার্থে তাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে রেখেছে।