মালয়েশিয়ায় হুন্ডির দাপট, প্রণোদনা বাড়ানোর পরও রেমিট্যান্সে ভাটা

0

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম শীর্ষ খাত রেমিট্যান্স। গত চার বছর ধরেই টানা বাড়ছিল রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। গত অর্থ বছরে রেকর্ড পরিমাণ আয় এলেও বাস্তবে আগের বছরের চেয়ে আয় কমে গেছে। কারণ বৈধ পথে আয় পাঠাতে খরচ আছে। আর অনানুষ্ঠানিক বা হুন্ডিতে (অবৈধ লেনদেন) আয় পাঠালে প্রতি ডলারে ৫-৬ টাকা বেশি দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে অনেকে হুন্ডির পথে ঝুঁকছেন। এছাড়া চলমান ডলারে ভিন্নতার কারণে বেড়েছে হুন্ডির দাপট। আর এ দাপটে প্রণোদনা বাড়িয়েও বাড়ছে না প্রবাসী আয়।

২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি মার্কিন ডলার। তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমতে পারে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।

প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বিশ্বে শীর্ষ ৩০দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ার অবস্থান ছিল পঞ্চম। দেশটি থেকে বৈধ পথে ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রবাসী আয় এসেছে দুই হাজার ২ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে সপ্তম অবস্থানে নেমে এসেছে মালয়েশিয়া। চলতি অর্থ বছরের জুলাই মাসে ১১০ দশমিক ৭০ মিলিয়ন, আগস্টে ৯৬ দশমিক ২৪ মিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে ৮৩ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। যা গত অর্থবছরে গড়ে পাঠানো প্রবাসী আয়ের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম।

সংশ্লিষ্ট খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারি শুরুর পর উড়োজাহাজ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বাণিজ্যের লেনদেন কমতে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় অনানুষ্ঠানিক লেনদেন। প্রবাসীরা বাধ্য হয়ে ব্যাংকে টাকা পাঠানো শুরু করেন। যার ফলে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে। এখন যোগাযোগব্যবস্থা চালু হয়েছে, কর্মীদের যাওয়া-আসা বেড়েছে। ডলার আর আগের মতো সীমান্ত অতিক্রম করছে না। তাই দেশের রিজার্ভও বাড়ছে না। এছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো প্রবাসী আয়ে সরকার আগে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিতো। গত ১ জানুয়ারি থেকে প্রণোদনার হার বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। যদিও এটি ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব ছিল প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের।

এদিকে, সরকারি প্রণোদনা বাড়িয়েও প্রবাসী আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে দেশে তৈরি হয়েছে ডলার সংকট। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সায় উঠেছে। এর ফলে বেড়েছে আমদানি পণ্যের দাম।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের রেমিট্যান্স হাউজের মাধ্যমে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৬৮ দশমিক ২০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ায় অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউস এসডি এন বিএইচডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালক খালেদ মোর্শেদ রিজভী বলেন, বর্তমানে ডলারের বিনিময় হারের ব্যাপক তারতম্যের কারণে আমরা গ্রাহকদের উপযুক্ত বিনিময় রেট দিতে পারছি না। মালয়েশিয়া থেকে গত অর্থবছরের তুলনায় বর্তমান অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৪৯ দশমিক ২৮ শতাংশ রেমিট্যান্স কমে গেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য মালয়েশিয়া থেকে অগ্রণী ব্যাংকের হিসাবে টাকা পাঠালে সরকার ঘোষিত ২ দশমিক ৫ শতাংশের অতিরিক্ত আরও শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থাৎ সর্বমোট তিন শতাংশ বোনাস দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রবাসী আয় কমার অন্যান্য কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এর পাশাপাশি বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ানোর দিকে জোর তৎপরতা চলছে। শিগগির প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়তে শুরু করবে।

অন্যদিকে, প্লাসিড মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে গত বছর প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন টাকা। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঠিয়েছেন মাত্র ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন টাকা। যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে প্লাসিড মানি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ডলার সংকটের কারণে রেমিট্যান্স খাতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, সেটা কাটিয়ে উঠতে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। তবে এই মুহূর্তে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ সহায়তা বাড়ানো উচিত।

চলমান ডলার সংকটের কারণে রেমিট্যান্স কমে আসছে বলে মনে করেন এনবিএল মানি ট্রান্সফার মালয়েশিয়ার সিস্টেম অ্যানালিস্ট ম্যানেজার, এম.ডি. শামছুদ্দিন এনাম।

তিনি বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এনবিএল মানি ট্রান্সফার থেকে ৪৫২ কোটি টাকা প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা গত বছরের তুলনায় ৩৭ ভাগ কম।

শামছুদ্দিন এনামের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ ডলারের বিপরীতে টাকার রেট বিভিন্ন ব্যাংক ভেদে ৯৩ দশমিক ৫০ থেকে ৯৯ দশমিক ৫০ এক্সচেঞ্জ রেট দেওয়া হচ্ছে। যা প্রতি লাখ ডলারে ব্যাংক ভেদে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা ব্যবধান আছে। ডলারের রেটের অনেক ভিন্নতার কারণে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো প্রবাসীদের প্রত্যাশিত রেট দিতে পারছে না। ডলারের এই ব্যবধান যদি কমিয়ে আনা যায় তাহলে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো প্রবাসীদের প্রত্যাশিত টাকার রেট দিতে পারবে ও প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে না পাঠিয়ে বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বলেন, প্রণোদনার চেয়েও বেশি টাকা পাওয়া যায় হুন্ডির মাধ্যমে। করোনার প্রভাবে টাকা লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক সব খাত প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবাসী আয় অনেক বেড়েছিল। ভিসা–বাণিজ্য, আন্ডার–ইনভয়েসের (প্রকৃত মূল্য কম দেখানো) মতো অবৈধ পথ আবার চালু হয়ে গেছে। এতে এখন বেড়েছে হুন্ডি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে বিদেশে অবৈধ উপায়ে সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com