সিলেট ও সুনামগঞ্জে খাবার-পানির জন্য আকুতি
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার পাঁচ দিন কেটে গেছে। ঘরবাড়ি থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। অনেক রাস্তাঘাট থেকে পানি নেমে গেছে। গত কয়েক দিন যেখানে নৌকার অভাবে কেউ যেতে পারেননি, এখন সড়ক যোগাযোগের কিছুটা উন্নতি হওয়ায় সেখানে যাওয়া যাচ্ছে। এরপরও কিছু কিছু জায়গায় বানভাসি মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন।
তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান সর্বত্র ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা দেখা দেওয়ায় শুরুর দু-একটা দিন জলযানের সংকটে ত্রাণ পৌঁছাতে সমস্যা হয়েছিল। এখন সে সমস্যা কেটে গেছে। ত্রাণের কোনো সংকট নেই। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনও বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হচ্ছে। অনেক জায়গায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে। বন্যায় প্লাবিত হওয়া সিলেট নগরের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি পুরোপুরি নিরাপদ বলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষে সিলেট সেনানিবাসের মেজর খন্দকার মো. মুক্তাদির গতকাল বিকেলে ঘোষণা দেন। এ সময় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার—এই পাঁচ জেলায় মুঠোফোনের ৩ হাজার ৬১৭টি টাওয়ারের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ১৪৬টি সচল হয়েছে।
বন্যার পানি কমায় সুনামগঞ্জ মধ্য শহরের দু–একটি এলাকায় গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে যান চলাচল। দু–একটি দূরপাল্লার বাসও সুনামগঞ্জ থেকে ছেড়ে গেছে। তবে জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের স্থানে স্থানে পানি থাকলেও অনেক ট্রাক, বাস, পিকআপ ও মাইক্রোবাস চলাচল করতে দেখা গেল। ওই সড়ক দিয়ে গতকাল সকাল থেকেই সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সঙ্গে এসব যানবাহন চলেছে। এর ফলে সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের চার দিনের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটল।
এদিকে, গতকাল দুপুরে সিলেটের বিশ্বনাথের লামাকাজী ইউনিয়নের দিঘলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ২৭ জনের সঙ্গে কথা হয়। প্রত্যেকেই অভিযোগ করেন, গত বুধবার বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে দুই-তিন দিনের ব্যবধানে ৮০টি পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছে। এসব পরিবারের লোকসংখ্যা প্রায় ৪০০। বন্যা শুরু হওয়ার পরদিন গত বৃহস্পতিবার প্রতিটি পরিবার ১০ কেজি করে চাল পেয়েছিল। গত রবিবার রাতে প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ ছিল এক বাটি আখনি। এ ছাড়া, আর কিছুই তারা পাননি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দিঘলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনের নিচতলা পানিতে থই থই। দোতলা ও তিনতলায় আশ্রয়কেন্দ্র। এই দোতলা আর পাশে থাকা আরেকটি একতলা ভবনের মোট ১০টি কক্ষে আশ্রয় গ্রহণকারীরা গাদাগাদি করে থাকছেন। বেশ কয়েকটি পরিবার বারান্দার মধ্যেও আছে। বেঞ্চ-টেবিল একত্র করে কিংবা মেঝেতে কেবল বিছানা–চাদর ও পুরোনো পত্রিকার কাগজ বিছিয়ে তারা থাকছেন। তবে অতিরিক্ত মানুষ গাদাগাদি করে থাকায় অনেকে পালা করে ঘুমাচ্ছেন।
তবে ঘুমের চেয়ে খাবারের সমস্যা বেশি ভোগাচ্ছে জানিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা খোজারপাড়া গ্রামের সায়েক মিয়া (৪৩) বললেন, ‘ঘরের মালসামানা (জিনিসপত্র) ফালাইয়া জান লইয়া কুনুমতে আইছি। আমার পরিবারও চাইরজন মানুষ। ১০ কেজি চাউল ছাড়া আর কুনতাই পাইছি না। চাইয়া-মাইগা ঋণ কইরা চলরাম। ক্ষুধায় পেরেশান আমরা।’
এদিকে, আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন গ্রামে ত্রাণের জন্য মানুষকে আকুতি জানাতে দেখা গেছে। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সিঙ্গুরা গ্রামের পারভীন আক্তার বলেন, দরকার সত্ত্বেও তার পরিবার কোনো ত্রাণ পায়নি। সিলেটের বিশ্বনাথের দিঘলী দত্তপুর গ্রামের জীবন মিয়া (২০) জানান, ঘরের ভেতরে পানি উঠে পড়ায় টানা তিন দিন তাঁরা সিঁড়ির মধ্যেই কাটিয়েছেন। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও পাননি কোনো ত্রাণ।
সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত হাজারো গ্রামের একটি সিঙ্গুরা। ছাতক উপজেলার ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের এই গ্রামে ১৫০ পরিবারের বাস। এর মধ্যে শতাধিকের বেশি ঘরবাড়ি টিন, বাঁশ ও মাটির তৈরি। গত বুধবার রাতে ভারী বৃষ্টি আর ঢলে এক ঘণ্টায় তলিয়ে যায় পুরো গ্রাম। এখনো ৯০ শতাংশ ঘর প্লাবিত। এসব ঘরে হাঁটু থেকে কোমরপানি। পানির তীব্র স্রোতে কাঁচা ঘরের অধিকাংশই বিধ্বস্ত। টিনের বেড়া দুমড়েমুচড়ে গেছে। শিকড় উপড়ে কিছু গাছ ভেসে গেছে। রাস্তায় খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।
গতকাল বিকেলে গ্রামটিতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। গ্রামের মানুষ বলছেন, আকস্মিক বন্যায় গাছপালাবেষ্টিত সবুজ-শ্যামল গ্রামটি একেবারেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি পরিবারে হয় গবাদিপশু নতুবা হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে।
সিঙ্গুরা গ্রামেরই একজন বাবুল মিয়া (৩৫)। তিনি সিলেট-দিরাই সড়কপথে বাস চালান। গত বুধবার রাতে হঠাৎ পানি প্রবল বেগে ঘরে ঢুকতে থাকে। এক কাপড়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যান তিনি। হতাশ কণ্ঠে বললেন, এই বন্যা তাকে হঠাৎ করেই গরিব বানিয়ে দিয়েছে। আবার নতুন করে তাকে সংসার সাজাতে হবে।
একই গ্রামের পারভীন বললেন, তাদের ঘরে গলাপানি। গ্রামের পাশে উঁচু একটা খুপরিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে সন্তানেরা হরলিকস, গুঁড়া দুধ ও ডিম খাওয়ার বায়না ধরেছে। কিন্তু এসব খাবার কেনা তো দূরের কথা, সন্তানদের ঠিকমতো ডালভাতও খাওয়াতে পারছেন না। সরকারি কোনো ত্রাণও তাঁরা পাননি।