স্কুলে ওড়না নিষিদ্ধের নেপথ্যে সেই বিতর্কিত ডিসি!
সম্প্রতি রাজধানীর সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রীদের ওড়না পরতে নিষেধাজ্ঞা জারী করার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন সিনিয়র যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। গতকাল এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি এর দায় স্বীকার করলেও জনরোষে পড়ে আজ সে পোস্ট মুছে দিয়েছেন তিনি।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি এই ওড়না নিষিদ্ধের ব্যাপারটিকে ইসলামী মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলন বলে উল্লেখ করেন। এবং এর প্রতিবাদে অংশগ্রহনকারী অভিভাবকদের জঙ্গিবাদী, মৌলবাদী, কায়েমি স্বার্থবাদী অভিভাবক বলে আখ্যায়িত করেন। এবং এসব অভিভাবকদের চিহ্নিত অপরাধী আখ্যা দিয়ে তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে শাস্তি দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন।
এদিকে বিক্ষুব্ধ অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি পর পাওয়ার পর থেকেই স্কুলটিতে বহুদিন ধরে চলা ধর্মীয় ঐতিহ্য ধ্বংসের উদ্যোগ নেয় আবু হেনা মোরশেদ জামান। গত বছরের শুরুতে স্কুল থেকে দেয়া ড্রেসকোডের বিবরণে ছাত্রীদের স্কুল পোষাকের স্থানে সাদা ওড়নার কথা স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও আবু হেনার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ৩০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত এক নোটিশে তা হঠাৎ করেই পরিবর্তন করে দেয়া হয়। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করতে থাকে। ৩০ অক্টোবর’১৯ এ প্রকাশিত নোটিশে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির ছাত্রীদের ড্রেসকোডে বলা হয়- ‘নেভী ব্লু কামিজ ও সাদা সালোয়ার। এ সাথে চওড়া ক্রস বেল্ট ওড়না এবং মাথায় হিজাব (ঐচ্ছিক) পরিধান করবে। সাদা জুতা (কেডস) ও মোজা পরতে হবে।’ অথচ পূর্বের ড্রেসকোডে বলা ছিল- ‘গায়ে সাদা রঙের ওড়না ও সাদা রঙের ক্রস ওড়না’। লক্ষ্যণীয় যে, নতুন ড্রেসকোডে শুধু গায়ের ওড়নাই বাদ দেয়া হয়নি, বরং মাথার হিজাবকেও কৌশলে ঐচ্ছিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এই ইউনিফর্মকেই অধিকতর উন্নত, পরিশালিত ও পরিমার্জিত বলে ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
কে এই আবু হেনা মোরশেদ জামান?
ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের হোতা নাস্তিক আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে জুতা মিছিল করেছিল নরসিংদীর জনসাধারণ। সে সময় নরসিংদী জেলার ডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ৮৫ শতাংশ সরকারি জায়গা নামসর্বস্ব এক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি মাত্র ৭০ লাখ টাকায় শ্রেণি পরিবর্তন করে বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনকি দুর্নীতি করে নিজ মাকে বেগম রোকেয়া পদক পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তৎকালীন এই দুর্নীতিবাজ জেলা প্রশাসক। জাতীয়ভাবে বেগম রোকেয়া পদক পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে নরসিংদী জেলার কোনো কৃতি নারীর নাম প্রস্তাব না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে চট্টগ্রাম এলাকার বাসিন্দা তার মা দিল আফরোজের নাম প্রস্তাব করেছিলেন ডিসি আবু হেনা।
১৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে নরসিংদীতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে ডিসি আবু হেনার এসব দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়ে পড়লে পুরো জেলায় জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ নভেম্বর’১৬ তারিখে নরসিংদী জেলা প্রশাসক আবু হেনার বিভিন্ন দুর্নীতি অনিয়মও নানা অনৈতিক কাজের প্রতিবাদে স্থানীয় আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগসহ সর্বস্তরের আমজনতা একটি মিছিল শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয় ঘেরাও করে।
দুদক ম্যানেজ করে উল্টো পদোন্নতি!
গণশুনানিতে ডিসি আবু হেনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ফিরিস্তি শুনে তৎকালীন দুদক কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ সেদিন বলেছিলেন, ‘জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বরাদ্দ দেওয়া ও রোকেয়া পদক প্রদানে অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হবে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।’
এসময় তিনি আরও বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তারা যেই হোক না কেন তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়; অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে। ভুক্তভোগীদের সব অভিযোগই যাচাইকালে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।’
কিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সবকিছু সামলে নেন দুর্নীতিবাজ নাস্তিক ডিসি আবু হেনা মোরশেদ কামাল। নরসিংদী ছাড়তে হলেও তিনি দুদককে ম্যানেজ করে ফেলেন দ্রুতই। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে পেয়ে যান উল্টো পদোন্নতি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে বর্তমানে তিনি সিনিয়র যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন।
একক সিদ্ধান্তে স্কুলের ড্রেসকোড পরিবর্তন!
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন- আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের তিনটি ক্যাম্পাসে প্রায় ২৬০০০ ছেলেমেয়ে পড়ছে। ৫২০০০ অভিভাবক আছেন এদের। কিন্তু তাদের সাথে কোনো প্রকার মতবিনিময় কিংবা পরামর্শ না করেই যুগ্ম সচিবের পরিচয় ব্যবহার করে একক সিদ্ধান্তে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাত্রীদের ওড়না নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করেছে আবু হেনা। খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষক ও অভিভাবক তার এ একক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্কুলের ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে। রাস্তা-ঘাটে তারা একসময় যে সম্মান পেত, এখন তারা তা পাচ্ছে না। এমনকি বখাটেদের উৎপাতে ছাত্রীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ওই অভিভাবক।
ওড়না নিষিদ্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
ওড়না নিষিদ্ধ করায় ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বিক্ষোভ করেছেন৷ এ সময় তারা রাস্তাও অবরোধ করেন৷
অভিভাবকরা বলছেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ চলতি বছর থেকে ছেলেদের টুপি ও মেয়েদের ওড়না পরা ঐচ্ছিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ ১৯৭৩ সাল থেকে এটি (টুপি ও ওড়না পরা) স্কুলের একটি ঐতিহ্য ছিল এবং আমাদের এতে কোনো সমস্যা নেই৷ কর্তৃপক্ষ কেন আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে তড়িঘড়ি করে এমন একটি ইসলাম-বিরোধী সিদ্ধান্ত নিল? ওড়না, স্কার্ফ ও ছেলেদের টুপি নিয়ে যেহেতু অভিভাবকদের কোনো অভিযোগ নেই, সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কেন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল। এটা যদি করতেই হতো তাহলে অভিভাবকদের সঙ্গে বসতে পারত। পরামর্শ নিতে পারত, কিন্তু কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠান এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনেকেই বলছেন, বিভিন্ন ধরনের ফি নির্ধারণ ও বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিজেরা যা মনে করে তাই করে। ইচ্ছা মতো ফি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানের এমন বাড়াবাড়ি শুধু এই ইস্যুতেই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ রকম আচরণ করে প্রতিষ্ঠান। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। অবিলম্বে ওড়না, স্কার্ফ ও ছেলেদের টুপি ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক।
অধ্যক্ষের কথার সঙ্গে বাস্তবের প্রতিফলন নেই উল্লেখ করে অভিভাবকরা বলেন, নিরাপত্তাকর্মীরা ছাত্রীদের ওড়না পরে স্কুলে ঢুকতে দিচ্ছে না। অনেকে গেট থেকে ব্যাগে করে ওড়না নিয়ে স্কুলে ঢোকার পর ক্লাসে গিয়ে তা পরলেও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক শিক্ষকরা ক্লাসে গিয়ে এ ‘অপরাধের’ জন্য মেয়েদের বকাঝকা করছেন।