রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুঘলকিকান্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে, সে সময় তাদের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো এবং লোডশেডিং থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া। সেসময় এটি অন্যতম রাজনৈতিক ইস্যুও ছিলো। ফলে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় বিশেষ ব্যবস্থায় আমদানিকৃত তরল জ্বালানি নির্ভর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই না হওয়া ও ব্যাপক ব্যয়বহুল হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধিতা করেন। তবে সরকার সাময়িক সমাধান হিসেবে রেন্টাল- কুইক রেন্টাল চালু করেছিলো। অন্যদিকে একটি টেকসই ও নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো- নিজস্ব সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অন্তত বছর তিনেক সময় লাগবে; সংকট উত্তরণে সেই মেয়াদের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তবে সরকারের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও ভাড়াভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরকার সরে তো যায়ইনি; বরং দফায় দফায় এসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে এ ধরনের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যাও। ফলে বিদ্যুতের দামও গত ১১ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে। সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মালিকানায় থাকা এসব কেন্দ্র থেকে চড়া দামে বিদ্যুৎ কিনে বিপুল অংকের টাকা লোকসান দিচ্ছে পিডিবি। প্রতিবছরই এই প্রতিষ্ঠান ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। দফায় দফায় বিদ্যুৎ বিল বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকেই এই লোকসান উসুল করা হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা অভিযোগ করেছেন। নভেম্বরে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বছরে যতবার ইচ্ছা বিদ্যুতের দাম পরিবর্তন করা যাবে। এব্যাপারে আইনও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তবে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রেখে দাম বাড়ানের প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এসব কেন্দ্র বন্ধ হলে নতুন করে আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবের পর ২২ ডিসেম্বর কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সরকারি বিদ্যুৎ সেবার বিভিন্ন পর্যায়ে বছরে অন্তত ১০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা অযৌক্তিকভাবে ব্যয় হচ্ছে। ওই ব্যয় সমন্বয় না করে মূল্য পরিবর্তনের যে কোনো উদ্যোগে তাদের আপত্তি রয়েছে। ক্যাব নেতারা বলেছেন, ইতোমধ্যেই তারা উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে বিভিন্ন ‘অযৌক্তিক ব্যয়ের’ একটি তালিকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে দিয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের ওপর ইতোমধ্যে গণশুনানিও শেষ করেছে বিইআরসি। গত ৩ ডিসেম্বর শুনানি শেষ হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে পিডিবিসহ সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো জানুয়ারি থেকেই বর্ধিত মূল্য কার্যকরের কথা বলেছে। গত ২৮ নভেম্বর গণশুনানি শুরুর প্রথম দিন থেকেই সেখানে অংশ নিয়ে বিদ্যুৎখাতে নানা অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তোলেন ক্যাবসহ বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। ওই শুনানিতে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা এসেছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ায় রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা। তারা বলেছেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হলে বিদ্যুতের দাম আর বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দিয়ে সরকার বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে। অবিলম্বে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানিয়ে তারা বলেছেন, বেশি দামের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন আর দরকার নেই। এগুলো বন্ধ হলে বিদ্যুতের দাম আর বাড়ানোর দরকার পড়বে না। তারা বলেন, ২০০৯-১০ সালে আপাত-সংকট কাটাতেই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চালু করেছিল। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে সরকার তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে। কিন্তু বর্তমানে যেখানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেশি, সেখানে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই। ক্যাবের সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রেন্টাল বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে বছরে ১৩০৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেয় পিডিবি। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা পর্যাপ্ত হওয়ার পরেও সরকার বিশেষ প্রয়োজনে চালু করা এই বোঝা এখনও ধরে রেখেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের নামে গ্রাহকের কাছ থেকে ২১৭৬ কোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে, যা অযৌক্তিকভাবে ব্যয় করা হচ্ছে বলে মনে করছে ক্যাব। সঞ্চালন পর্যায়ে ‘সিস্টেম লস’ বাড়িয়ে ধরায় অতিরিক্ত ১১০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলেও মনে করছে ক্যাব। তারা বলছে, পাইকারি বিদ্যুতে পিডিবি মুনাফা করছে ৫০০ কোটি টাকা, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাদের মুনাফা করার সুযোগ নেই। সরকারের নানা ভুল নীতির কারণে পাইকারি বিদ্যুতে ঘাটতি হচ্ছে ৪৫০০ কোটি টাকা, সেই ভারও গ্রাহকের ওপর চাপানো হচ্ছে। এছাড়া সঞ্চালন ও বিতরণে লভ্যাংশ বাড়ানোর কারণে ১৩ কোটি টাকা, বিতরণে পিডিবি ও আরইবির (পল্লী বিদ্যুৎ) মুনাফার কারণে ১৯৮৮ কোটি টাকা এবং আরইবিতে জনবল ও অবচয় বাবদ ৮০২ কোটি টাকা (মোট ১০,৫৪৯ কোটি) ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ হচ্ছে। এই অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করার পর পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার এবং সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ক্যাব। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেছেন, ২০০৯ সালের দিকে ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ গ্যাস থেকে উৎপাদন হলেও এখন সেটা কমে ৬০ শতাংশে নেমেছে। নতুন করে যোগ হয়েছে ব্যয়বহুল এলএনজি, কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর ‘কুফল’ গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপর।“সাশ্রয়ী জ্বালানি পেতে সরকারের পরিকল্পনা খুবই দুর্বল। গত ১০ বছরে সাগর থেকে গ্যাস উৎপাদনে কোনো অগ্রগতি নেই।” সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “বর্তমান সরকারের সময়ে গত ১০ বছরে পাইকারিতে ৭ বার আর খুচরায় ৯ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটা খুবই অন্যায়। রাষ্ট্র কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। অথচ সরকার মুনাফার দিকে বেশি নজর দিচ্ছে।” স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সমুদ্র জয়ের পর বেশ ডামাডোল শোনা গেলেও এখন আর এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সমুদ্র ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলনে অনেক এগিয়ে। বিদ্যুতের বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে ‘চুরির প্রবণতার’ কারণেই এখন দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, “অনেকে বলেন, বিদ্যুতে প্রচুর অপচয় হচ্ছে। আমি বলব- এগুলো অপচয় নয়, এগুলো সরাসরি চুরি।”
সরকারের অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণেই বিদ্যুত খাতে খরচ বাড়ছে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবেই বিদ্যুতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সব ধরনের ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ কমানো গেলে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। একইসঙ্গে তারা সাশ্রয়ী জ্বালানি নিয়ে যুগোপযোগী পরিকল্পনারও পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন, সুচিন্তিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বিদ্যুতের মূল্য কমবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহে বিশেষ আইন করা হয় ২০১০ সালে। উদ্দেশ্য ছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। কার্যকর হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আইনটির। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, বিশেষ আইনের আওতায় গত নয় বছরে নতুন ৯৬টি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা সম্ভব হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। বর্তমানে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৩টিতে। কয়লাভিত্তিক ২০টিসহ ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলভিত্তিক আরো অর্ধশতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। আইনটির আওতায় দীর্ঘমেয়াদি কয়লাভিত্তিক কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্পই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পুষতে গচ্চা হাজার হাজার কোটি টাকা
রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুষতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে সরকারের। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ কেন্দ্রের মালিকানার সঙ্গে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা আর মন্ত্রী-এমপি জড়িত থাকায় সরকার তাদের কাছে একদিকে বেশি দামে তেল কিনে কম দামে বিক্রি করে টাকা গচ্চা দিচ্ছে। অপরদিকে, রেন্টালদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে তা গ্রাহকের কাছে কম দামে বিক্রি করে রাজস্ব হারাচ্ছে। এ ছাড়া ভুর্তকির নামে ছাড় করা অর্থ পিডিবির নামে ঋণ হিসাবে দেখিয়েও প্রতি বছর শ’ শ’ কোটি টাকার বেশি গচ্চা দিচ্ছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের সঙ্গে জড়িত বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে সুবিধা দিতে গিয়ে, তাদের লাভের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় এত বেশি বেড়ে গেছে। যার দায় বইতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুৎখাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মাধ্যমে। বাতিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে তার মাধ্যমে শ’ শ’ কোটি টাকা হাতানো হয়েছে রেন্টালে। বিদেশের ব্যবহৃত, অতি পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমস্যা হচ্ছে এগুলো তেল খরচ করে বেশি, সেই তুলনায় বিদ্যুৎ দেয় অনেক কম। খুবই খরুচে এবং এ কারণেই ক্ষতিকর। রেন্টালে যে পুরনো যন্ত্রপাতি আসছে এটা সরকারের কর্তাব্যক্তিরা স্বীকারও করেছেন বেশ কয়েকবার।
পিডিবির দেয়া তথ্য মতেই, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য আমদানি করা যন্ত্রপাতির শতকরা ৮০ ভাগই হচ্ছে পুরনো। বিশেষজ্ঞরা জানান, যেখানে নতুন একটি যন্ত্রের দাম এক হাজার কোটি টাকা, আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা সেটা এনেছেন মাত্র ২০০ কোটি টাকায়। ফলে ব্যয় তাদের কমেছে। লাভও হয়েছে। যারা যন্ত্রের কাগজপত্র থেকে নীতিগত অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত সবাই এর অংশীদার। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়।
তেল ক্রয়-বিক্রয়ে অস্বচ্ছতা
রেন্টাল দুর্নীতির প্রধান অনুষঙ্গটা হচ্ছে এই তেল। চুক্তি অনুযায়ী সরকার রেন্টালগুলোতে তেল সরবরাহ করে ভর্তুকি মূল্যে। কিন্তু কী পরিমাণ তেল একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দেয়া হয় তার হিসাব যথাযথভাবে নেয়া হয় না। কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমস্যা হলে বা উৎপাদন হ্রাস পেলে কী ব্যবস্থা নেয়া হয় তাও জানা যায় না। কত তেল প্রয়োজন আর তার প্রেক্ষিতে কত দেয়া হচ্ছে এই তথ্যটা লুকাতেই এই গোপনীয়তা। বিপিসির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিপিসিকে সরকার ভর্তুকি দিয়েছিল দেড় হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকায়। মাঝের দুই অর্থবছরে অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৯০০ কোটি টাকা এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ৪ হাজার কোটি টাকা।
বিপিসির ভর্তুকির পরিমাণ এ অস্বাভাবিক পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ও ওঠা নামার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, রেন্টালে অতিরিক্ত তেল দেয়াটাই এর জন্য দায়ী। এই বিপুল পরিমাণ তেল কিনে আনতে গিয়ে এবং তা কম মূল্যে রেন্টালে সরবরাহ করতে গিয়ে সরকার বিরাট এই ক্ষতির মুখে পড়ছে।
রেন্টালের তুঘলকি বিল পরিশোধ
রেন্টালের অধিকাংশই তেলভিত্তিক হওয়ায় এগুলো শীতকালে বিদ্যুৎ চাহিদা কম থাকাকালে বা গ্রীষ্মে তেলের চাহিদা খুব বেড়ে গেলে তেল দিতে না পারার কারণে, এরকম অনেক সময়ই বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে বলা আছে, বন্ধ থাকলেও উৎপাদন ক্ষমতার সমান টাকা তাদের দিতে হবে। অথচ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সরকারি হলে শুধু কর্মকর্তাদের বেতন ছাড়া আলাদা কোনো খরচের দরকার পড়ত না। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদন নেই, তবু মাসে শত কোটি টাকা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও এর পিছনে শ’ শ’ কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। পিডিবি সূত্র জানায়, এমন অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে যেখান থেকে এক ইউনিটও বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি কিন্তু কোনো কোনো মাসে তাদেরকে কয়েক কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। কোন কোন কেন্দ্রে বিদ্যুতের দামের চেয়ে নির্ধারিত খরচ বেশি হচ্ছে।
এভাবে প্রতিটি ভাড়ায় আনা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনের সাথে কোন সামঞ্জস্য না রেখেই মোটা অংকের অর্থ গচ্ছা দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক না হোক নির্ধারিত অর্থ তাদের দিতেই হয়। যারা কেন্দ্র স্থাপনে বিনিয়োগ করেছেন তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও নির্ধারিত অংকের টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে এই অর্থ লেনদেনের খুব বেশি সম্পর্ক নেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনের জন্য কাগজে-কলমে তৈরি থাকলেই হলো। বিদ্যুৎ যতটা দেয়ার কথা ছিল তা পুরোটা দিতে না পারলেও বিনিয়োগকারীর তাতে কোন লোকসান নেই।
পছন্দের রেন্টালের মেয়াদ বৃদ্ধি
মেয়াদ খুব অল্প দিনের। শুধু সঙ্কট কাটাতে জরুরি এই ব্যবস্থা- রেন্টাল সম্পর্কে গোড়ায় এসব কথা বলা হলেও কোনো কোনো রেন্টালের মেয়াদ ১৫ বছর হতেও দেখা গেছে। মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে মেয়াদ বেড়েছে অনেকের। আগের দামের চেয়ে বিদ্যুৎ কেনার দামও বেড়েছে। যদিও তা কমার কথা। কারণ প্রথমে স্থাপন ব্যয় ছিল পরে যা নেই। এভাবেই রেন্টালের মেয়াদের সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতি। শুধু তা নয়। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে পছন্দের রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ইচ্ছেমতো। মেয়াদ না বাড়িয়েও চালু রাখা হয়েছে, এমনও নজির আছে।
নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যুতের দামের মধ্যে পাওয়ার প্ল্যান্টের দাম, স্থাপন খরচ, পরিচালন ব্যয় এবং মালিকের লাভ অন্তর্ভুক্ত থাকে। যখন কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এর সঙ্গে সঙ্গে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতির দাম এবং স্থাপন খরচ পরিশোধ অর্থাৎ উসুল হয়ে যায়। ফলে নতুন করে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলে সেগুলো আর বিদ্যুতের দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এক্ষেত্রে শুধু পরিচালন ব্যয় পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হবে। মালিকের লাভের পরিমাণও এক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে ন্যূনতমহারে ধরতে হবে। এতে বিদ্যুৎতের দর ইউনিট প্রতি আগের চেয়ে অনেক কম হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রেন্টাল পাওয়ারের চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। সরকার বা জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা এর মাধ্যমে লুটপাট হয়েছে।
এক বছরে পিডিবির ব্যয় বেড়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালন ব্যয় এক বছরে বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সেই সাথে বাড়ছে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়সহ সামগ্রিক ব্যয়। এ জন্য দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, পিডিবির উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এতে পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। আর এ অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধির দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে জনগণের ঘাড়ে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক বিডি রহমত উল্লাহ বলছেন, পিডিবির হিসাব মতে, ৬২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে গ্যাসের মাধ্যমে। এতে পিডিবির সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কোনোক্রমেই সাড়ে ৩ টাকা থেকে ৪ টাকার ওপরে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিকে বিদ্যুতের মূল্য নেয়া হচ্ছে ১৩ টাকার ওপরে। আর গড়ে মূল্য নেয়া হচ্ছে প্রায় ৭ টাকা। এ ব্যবধানের প্রধান কারণ হলো অযৌক্তিক ব্যয় বাড়ানো। তিনি জানান, সরকারের দাবি অনুযায়ী বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বিদ্যুৎ বিতরণ গড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হচ্ছে না। এতে দেখা যায়, উৎপাদন ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ বিতরণ করতে হচ্ছে। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। আর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগই বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র। দায়মুক্তি দিয়ে টেন্ডার ছাড়াই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পিডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকারি অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই বসিয়ে রাখা হচ্ছে। বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। আবার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি মূল্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। এভাবে পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
পিডিবির এক হিসাব মতে, নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরে পিডিবির পরিচালন ব্যয় ছিল ১৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা, আগামী বছরে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) এ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। আর মেরামত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেশি। সেই সাথে এক বছরে জনবল ব্যয় বাড়বে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। যেমন নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরে জনবল ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। আগামী বছরের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পিডিবির ঘাটতি বেড়ে যাবে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, এ ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে; অন্যথায় লোকসান আরো বেড়ে যাবে।
প্রয়োজন বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় আমূল সংস্কার
গত ১০ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে খুচরা পর্যায়ে ৯ বার দাম বাড়াতে হয়েছে। এ সময় বেড়েছে জ্বালানির দামও। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরও সরকারের লোকসান সমন্বয় হয়নি। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পেতে হলে সাশ্রয়ী জ্বালানির দরকার। এসবের সমাধান করতে হলে সবার আগে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি ও দর্শনের বিষয়ে আবার ভাবতে হবে। কারণ, বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া সব সংস্কার মোটা দাগে ব্যর্থ হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের ফলে এ খাতে ব্যক্তিমালিকানার আধিপত্য বেড়েছে, সরকারি বিনিয়োগ কমেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত মানসম্মত হয়নি। এতে বিনিয়োগ-সংকট কাটেনি। কিন্তু এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনিয়োগকারীদের মুনাফা বৃদ্ধি গুরুত্ব পেয়েছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক এম শামসুল আলম মনে করেন, এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। সরকারি মালিকানায় বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ননীতি গৃহীত হতে হবে এবং সে মোতাবেক বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় (মাস্টারপ্ল্যান) আমূল সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। খাতটিকে ঢালাও বেসরকারীকরণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার কারণে বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা আরেক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়া নিচ্ছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্র নির্মাণ হতে হবে পরিকল্পিত। কোন এলাকায় কতখানি বিদ্যুতের প্রয়োজন, কখন কখন প্রয়োজন, সে অনুযায়ী কেন্দ্র নির্মাণ করা গেলে এ সমস্যা অনেকটা কমে আসবে। এ ছাড়া বিইআরসি আজ থেকে চার বছর আগে ন্যূনতম ব্যয়ে (লিস্ট কস্ট) বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল গ্রহণের যে আদেশ দিয়েছিল, সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে এ পরিস্থিতির আরও কিছুটা উন্নতি ঘটবে।
তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতে আরও একটি চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতিমুক্ত করা। সরকারের ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী সব ধরনের কেনাকাটা হতে হবে দরপত্রের মাধ্যমে। অথচ বিদ্যুৎ খাতের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে অযাচিত (আনসলিসিটেড) পদ্ধতিতে, দরপত্র ছাড়াই। একটি বিশেষ আইন তৈরি করা হয়েছে এ জন্য। ইতিমধ্যে এ আইনের মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। এখাতকে দুর্নীতিমুক্ত ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে এ আইনটি বিলোপ করে পিপিআর অনুযায়ী উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করতে হবে।