পদ্মা সেতু: ক্ষতিপূরণের ৩০ কোটি টাকা লোপাট, সাড়ে ৭ কোটি উদ্ধার
সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমি ভুয়া দলিলাদি ও কাগজপত্র দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালালচক্র। যদিও বিলে নামধারী মতি শেখসহ পাঁচজনের কাছ থেকে সাড়ে সাত কোটি টাকা উদ্ধার করতে সমর্থ হলেও আরো ২৩ কোটি এখনো রয়ে গেছে চক্রটির হাতে।
অজানা রয়ে গেছে মামলার বাইরে থাকা নেপথ্য চক্রের হোতাদের নাম।
সরেজমিন ও মামলা সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের অধীনে ০৬/২০১৭-২০১৮ নম্বর এলএ কেসে কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের মাগুরখণ্ড মৌজার ৩৮.৭৩ একর সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
এই জমি নিজেদের দাবি করে এক শ্রেণির দালালচক্র মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ শাখায় ভুল তথ্যসহ জাল দলিলপত্রাদি ও খতিয়ান জমা দেয়। তারপর তারা চেকও তুলে নেয়। এরপর বর্তমান জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হলে তিনি উপপরিচালক মো. আজহারুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। জেলা প্রশাসক স্থানীয় সংসদ সদস্য চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীকেও বিষয়টি জানালে তিনি সরকারি অর্থ পুনরুদ্ধারে প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দেন। এর পরই জেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে মতি শেখ, রমিজউদ্দিন হাওলাদার, হাকিম শেখ, মো. রাজ্জাক মোল্লা, মো. শাওনসহ পাঁচজনের কাছ থেকে সরকারি সাড়ে সাত কোটি টাকা উদ্ধার করে।
এলাকার এক ইউপি সদস্য চুন্নু বেপারী বলেন, অধিগ্রহণের আওতাভুক্তরা টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে টাকা পান। কিন্তু এই টাকাগুলো কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই কিভাবে পেয়ে গেল তা বোধগম্য নয়। এর পেছনে বড় ধরনের সিন্ডিকেট রয়েছে।
ভুয়া বিল উত্তোলনকারী কৃষক মতি শেখ বলেন, জাহাঙ্গীর মোল্লা আমাকে জমির কিছু কাগজে আমার নাম দেখিয়ে বলে এই কাগজ জমা দিলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। তাই আমার ও জাহাঙ্গীরের বাবা রাজ্জাক মোল্লার নামে দুটি বিল জমা দেয় জাহাঙ্গীর। বিল উত্তোলনের পরে আমাকে ২২ লাখ টাকা দেয় জাহাঙ্গীর। পরে জানতে পারলাম আমার নামে এক কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার টাকা বিল উত্তোলন করা হয়েছিল। যখন মামলার কথা জানতে পারলাম তখন আমি সব টাকা জাহাঙ্গীরের কাছে ফেরত দিয়েছি। জাহাঙ্গীরও সব টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে আমাকে ব্যাংকের কাগজ দিয়েছে। তবে আমরা বিল জমা দেওয়ার আগে বা পরে তদন্তে আমার কাছে কেউ আসেনি।
দালাল মো. জাহাঙ্গীর মোল্লা বলেন, এক কোটি ৮০ লাখ টাকার মধ্যে আমরা অর্ধেক টাকা পেয়েছি। বাকি টাকা খরচ বাবদ অফিসের লোকজন নিয়েছে। আমি শুধুমাত্র আমার বিলই জমা দিতে চেয়েছি। মতি শেখ তার বিল উত্তোলনের ব্যাপারে আমার সহযোগিতা চেয়েছে বলে আমি তাকে শুধুমাত্র সহযোগিতা করেছি।
ভুয়া বিল উত্তোলনকারী আজিজ মৃধার স্ত্রী বলেন, আমার স্বামীর নামে দুর্নীতির মামলা হয়েছে, তাই গত তিন-চার মাস যাবৎ সে নিখোঁজ রয়েছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঝোটন চন্দ বলেন, এ ঘটনায় আমাদের তিনজন সার্ভেয়ার জড়িত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি। সেখান থেকে তাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত দালালদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে।
মাদারীপুর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (তদন্ত কমিটির প্রধান) মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা ডিসি অফিসের এলএ শাখা, শিবচর ভূমি অফিসে সংরক্ষিত কাজগপত্র পর্যালোচনা করেছি। ক্ষতিপূরণের দাবীকৃত ২০টি আবেদনের সঙ্গে দেওয়া কাগজপত্রগুলো মাদারীপুর ও ফরিদপুর সাবরেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে সরেজমিন যাচাই করেছি। সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, এই ২০টি আবেদনকারী যে সকল দলিলপত্র দিয়েছেন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো কোনো দলিলে অন্য নামীয় দলিলের নম্বর সংযুক্ত করা হয়েছে। উপজেলা ভূমি অফিস থেকে নেওয়া বন্দোবস্তের যে সকল কাগজপত্র দেখানো হয়েছে সেগুলোও ভুয়া। এ সকল ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে তারা বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যায়।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের খাস খতিয়ানের জমির ভুয়া দলিল, পর্চাসহ কাগজপত্র দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ কোটি টাকার ওপরে নিয়ে গিয়েছিল প্রতারকচক্র। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পরে তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায়। পরে মিসকেস রজু করে ভুয়া বিল উত্তোলনকারীদের টাকা ফেরত দিতে বলা হলে এ পর্যন্ত প্রায় সাত কোটি ৩৫ লাখ টাকা ফেরত পাওয়া গেছে, যা সরকারি কোষাগারে জমা রয়েছে। বাকি ২৩ কোটির বেশি টাকা নিয়ে মামলা চলছে।
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, প্রশাসনের সাথে আমার কথা হয়েছে। এই দুর্নীতির সাথে শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, জনগণ যারা জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছি। অনেকে আটক হয়েছে। অনেকে টাকা ফেরতও দিয়েছে। প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। এই ভুয়া বিল উত্তোলনকারী চক্রটি একটি বড় ধরনের সিন্ডিকেট। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে বর্তমানে এই সিন্ডিকেট অনেকটাই ভেঙে গেছে বলে আমি মনে করি।
যারা এই লুটপাটের চেকের টাকা পায়:
২০টি চেকের মাধ্যমে সর্বমোট ৩০ কোটি ৮০ লাখ ২৩ হাজার ৩১৭ টাকা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামের তোতা মিয়া তালুকদার দুই চেকে মোট চার কোটি সাত লাখ চার হাজার ৫৮০ টাকা, শিবচর উপজেলার আমজাদ চৌকিদারকান্দি গ্রামের সিরাজুল ইসলাম চৌকিদারের স্ত্রী ফরিদা তিন কোটি ৩৭ লাখ ৪২ হাজার ২৯৭ টাকা, আজিজ ফকিরকান্দি গ্রামের ওরফান মৃধার ছেলে আজিজ মৃধা এক কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার ৩৫০ টাকা, চরজানাজাত ইউনিয়নের রব বেপারীকান্দি গ্রামের জলিল এক কোটি ৮৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৭৩ টাকা।
এ ছাড়া সারুলিয়া এলাকার মো. ফয়জল তালুকদার দুই চেকে দুই কোটি ৬৯ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৪ টাকা ও এক কোটি ৩৪ লাখ ২২ হাজার ৪৩৭ টাকা, লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামের রমিজদ্দিন হাওলাদার দুই চেকে এক কোটি ২২ লাখ ৮৫ হাজার ১৫ টাকা ও এক কোটি ৫৮ লাখ ৫৩ হাজার ১০৪ টাকা, শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের বাংলাবাজার গ্রামের আব্দুল মজিদ মোল্লা এক কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার ৭৬ টাকা, লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামের আব্দুল মান্নান বেপারী ৮৮ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৯ টাকা, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার লাল মিয়া সরকারেরকান্দি গ্রামের আ. হাকিম শেখ এক কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৮৯১ টাকা, শিবচর উপজেলার তোতা মিয়া বেপারীকান্দি গ্রামের মো. রাজ্জাক মোল্লা এক কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৮৯১ টাকা, লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামের মো. শাওন ৩৬ লাখ দুই হাজার ৯৬৮ টাকা, দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল গ্রামের মো. শাহীন ৪৯ লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ টাকা, ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার গেণ্ডারিয়া গ্রামের আ. খালেক ৮৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৪ টাকা, শিবচর উপজেলার ওসমান বেপারীকান্দি গ্রামের আলী হোসেন মল্লিক এক কোটি ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৪৬ টাকা, একই গ্রামের রাজা মিয়া জমাদ্দারের স্ত্রী স্বপ্না বেগম দুই কোটি দুই লাখ ৩৭ হাজার ৮০ টাকা, দত্তপাড়া ইউনিয়নের আর্য্যদত্তপাড়া গ্রামের সুধাংশু কুমার মণ্ডল ৪৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ টাকা।
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ