ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যেসব বিষয় বিবেচনা করা যায়

0

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে সামরিক সংঘাত চলছে তা কোনো জাতিগত সংঘাত নয়। জাতিগত ইউক্রেনীয় এবং জাতিগত রাশিয়ানরা সম্মুখ সারিতে থেকেই একে অন্যের সঙ্গে লড়াই করছে। এখানে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনে বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধের মূল প্রেরণা উগ্র জাতীয়তাবাদ নয়। মস্কো এ বিষয়ে যেসব বিবৃতি দিয়েছে তা অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীত ধর্মী। এটা ধর্ম নিয়েও লড়াই নয়। রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ই মূলত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং দুটি দেশে সম্প্রতি ধর্মীয় নবজাগরণের প্রসার ঘটেছে। একই সঙ্গে বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুরো অঞ্চলের দখল নিতেও এই লড়াই হচ্ছে না।

এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি বড় অংশ ছিল ইউক্রেন এবং রাশিয়া। কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আকস্মিক হামলা চালায় রাশিয়া। এই দ্বন্দ্বটি দুটি দেশের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। এটি দুই দেশের মানসিকতার মধ্যে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্বও বলা যায়।

ইউক্রেন ইতোমধ্যেই পশ্চিমা ধাঁচের উদার গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়া, পরিবর্তে, একটি এশিয়া বা ইউরোপীয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র নয়। তবে এটি গত ২০ বছর ধরে উদার গণতান্ত্রিক মডেল থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

ইউক্রেনীয় সমাজ ব্যবস্থা একেবারে মূল স্তর থেকেই সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি একেবারেই বিপরীত। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ইউক্রেন ছয়জন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রত্যেকেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর নির্বাচনের জয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। একই সময়ে রাশিয়ায় মাত্র তিনজন প্রেসিডেন্ট শাসন করেছে। প্রত্যেক নতুন নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেই খুব সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে এবং পূর্বসূরিরাই তাদের নির্বাচিত করেছেন।

ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এই উল্লেখযোগ্য ভিন্নতার কারণ নিয়ে বরাবরই বিতর্ক করে আসছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক সংগঠনের দুটি মডেলের এই মৌলিক অসামঞ্জস্যতা ইউরোপের একেবারে কেন্দ্রে একটি ভয়ঙ্কর ভ্রাতৃঘাতী সামরিক সংঘর্ষের দিকে পরিচালিত করেনি। তবে এটি সংঘাতে প্রতিটি পক্ষ কীভাবে কাজ করে তা নির্দেশ করে। কর্মী থেকে প্রচার এবং কৌশল থেকে রাষ্ট্রীয় শিল্প সব ক্ষেত্রেই দেশ দুটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে। এর প্রভাব ইউরোপেও পড়বে।

রাজধানী কিয়েভে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে লড়াইয়ের শর্তাবলী ন্যায্য ছিল না। রাশিয়া ইউক্রেনের চেয়ে বড়, ধনী এবং সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী। অন্যদিকে, ইউক্রেন আন্তর্জাতিক সহানুভূতি এবং পশ্চিমের কাছ থেকে প্রায় সীমাহীন প্রতিরক্ষামূলক, অর্থনৈতিক, মানবিক এবং গোয়েন্দা সহায়তা পেয়েছে। রাশিয়া শুধুমাত্র নিজের উপর নির্ভর করতে পারে এবং এই যুদ্ধের ফলে তাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়তে হচ্ছে।

অনেক রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, পশ্চিমাদের বিশাল সামরিক ও অন্যান্য সমর্থনের কারণেই ইউক্রেন এখনও বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়েনি বা আত্মসমর্পণ করেনি। কিন্তু এমন মন্তব্য ইউক্রেনের অনুপ্রেরণাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। আফগানিস্তানের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, যেখানে আমেরিকা এবং তার অংশীদারদের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী বৃহৎ আকারের সামরিক সহায়তা গত বছর তালেবানের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণকে আটকাতে পারেনি। যদিও দুটি দ্বন্দ্বকে সরাসরি তুলনা করা যায় না, তবে বাস্তবতা স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে। লড়াই করতে করতে ক্লান্ত আফগানরা ২০২১ তাদের দেশের জন্য এবং তাদের মূল্যবোধের জন্য লড়াই করতে আর আগ্রহ খুঁজে পায়নি। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা মাত্রই পুরো উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করেছে। তাই এখনও দুদেশের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। সংঘাতের পুরষ্কার কখনওই খুব ভালো কিছু হয় না।

যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে তার জন্য তিনটি পরিস্থিতি বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশাল ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি রয়েছে। ক্রেমলিন যদি এই অচলাবস্থায় চূড়ান্তভাবে হেরে যায়, তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু সাক্ষী হবে বিশ্ব। রাশিয়া নিজে থেকেই যুদ্ধ থামাতে আগ্রহী হলে আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হবে না। পুতিনের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ অসমাপ্ত কাজ হতে পারে। এছাড়া পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য মীমাংসার মাধ্যমেও সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটতে পারে।

যদি ইউক্রেনের বিষয়ে কোন চুক্তি না হয় এবং সংঘাতটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতির মধ্যেই স্থায়ী তাহলে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক বিস্তার এবং আঞ্চলিক সংঘাতের বৃদ্ধির কারণে অদক্ষ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে পারে। এ ধরনের পরিবর্তন সামনের বছরগুলোতে বিশ্বকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে একটি স্থায়ী চুক্তি প্রয়োজন।

তিনটি পরিস্থিতির যে কোনো একটির সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। সংস্কারের দৃশ্যকল্প বিবেচনা করলে দেখা যাবে সেখানে যুদ্ধ শেষ করার জন্য একটি চুক্তি করা হয় যা, সবার জন্য সেরা বিকল্প। অন্যরা হয় খুব দ্রুত পরিবর্তন মেনে নেবে বা প্রয়োজনীয় পরিবর্তনকে অবরুদ্ধ করবে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদি সংঘাত ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল এবং অহিংস পরিবর্তনের সূত্রপাত করে যাতে বিশ্বব্যবস্থা আরও স্থিতিশীল হয়ে ওঠে, এর অর্থ হবে যে মানবজাতি ইউক্রেনের বলিদান বৃথা হতে দেয়নি।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com