প্রতিরোধহীন ধর্ষণ

0

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অবুঝ শিশু, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, গৃহবধূ কেউই রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকের হাত থেকে! মানবাধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই তাদের উৎসাহিত করছে। এ বিষয়ে সংসদেও আলোচনা হয়েছে। সংসদে গত মঙ্গলবার ধর্ষককে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দুজন সদস্য। তাদের দাবি সমর্থন করেন আওয়ামী লীগের সাংসদসহ আরও দুজন। তবে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু আইন প্রয়োগ করেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার রেশ না কাটতেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে পাওনা টাকা আদায় করতে না পারায় বাবার সহায়তায় ১৩ বছরের কিশোরীকে দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে আবুল (৩৬) নামে এক দোকানির বিরুদ্ধে। গত মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে চিকিৎসা ও শারীরিক পরীক্ষার জন্য ওই কিশোরীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। ওই কিশোরীর বাবাকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত বছর দেশজুড়ে দেড় হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের (সিএমএম) সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৫০টি থানায় ২০১৯ সালে ৪৯৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দল বেঁধে ধর্ষণের মামলা ৩৭টি। ইতিমধ্যে ৪০২টি মামলায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ। মানবাধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ধর্ষকদের উৎসাহিত করছে। এছাড়া ধর্ষণের মামলায় সাজা হয় হাতেগোনা।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নির্দিষ্ট করে বলা আছে, ১৮০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলা শেষ করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি দুয়েকটি ঘটনায় আলোড়ন ওঠে। তারপর যা তাই, বছরের পর বছর মামলা পড়ে থাকছে, কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ফলে ধর্ষকরা দেখছে কোনো মামলারই বিচার হচ্ছে না। ঘটনার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ থাকছে না। ফলে সহজেই পার পাওয়া যাচ্ছে। ধর্ষকরা ভাবে এ দেশে বিচার হয় না এবং ক্ষমতার জোরে পার পাওয়া যায়। এ চিন্তাই তাদের আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। তখন এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতার অবক্ষয় এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যা বর্ণনা করার ভাষা নেই। ফলে অন্যায় করার প্রবণতাও বাড়ছে।’ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৭০৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ২৩৭টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৭ জনকে। আর আত্মহত্যা করেছে ১৯ জন। এছাড়া ২৪৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণ ও দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর দেশে ধর্ষণ ও দল বেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪১৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের হত্যার শিকার হয় ৭৬ জন এবং আত্মহত্যা করে ১০ জন। আর ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭৩২ নারী ও ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮১৮টি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বিকেলে মৌলভীবাজার শহরের স্টেডিয়াম এলাকায় কলেজছাত্রীসহ দুই বান্ধবী দল বেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, পূর্বপরিচয়ের সূত্রে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই দিন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে নিয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ছাত্রীর বাবা মামলা করার পর মোরসালিন ইসলাম (২১) নামে এক তরুণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

এর আগে গত রবিবার নরসিংদী সদর উপজেলায় বাজার থেকে পিঠা নিয়ে ফেরার পথে আট বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। গত শনিবার পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলায় ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ফিরোজ তালুকদার (৭০) নামে এক বৃদ্ধকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার ঢাকার ধামরাই উপজেলায় মমতা আক্তার (১৯) নামে এক শ্রমিককে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। শনিবার সকালে মেয়েটির ভাই মামলা করার পর ওই নারী শ্রমিককে বহনকারী বাসের চালক ফিরোজ এলাহী সোহেলকে (৩১) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই দিন বিকেলে যশোরের অভয়নগর উপজেলায় এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নবম শ্রেণিপড়ুয়া এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে দুদিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়।

দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। সেই সঙ্গে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত সম্পন্ন করে, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের চাওয়া ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ডা. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যারা এ কাজ করছে তারা মানসিকভাবে বিকৃত, অসুস্থ। এদের মানসিক ডেভেলপমেন্ট ঠিকমতো হয়নি, ফলে তাদের দ্বারা এগুলো হয়। এছাড়া ড্রাগ এখন হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আইন দিয়ে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতির উন্নতি করা লাগবে। যেমন আইনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে, আবার শিক্ষার ব্যবস্থাও থাকতে হবে, চারপাশের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com