ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নয়, অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়াবে: টিআইবি
বাংলাদেশের সংবিধান গোপনীয়তার যে অধিকার দিয়েছে, প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন সে গোপনীয়তার সুরক্ষা দেবে না। বরং ব্যক্তিগত তথ্য সরকারের মালিকানায় চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
আজ সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক ভার্চ্যুয়াল সভায় এ কথা জানিয়েছে। “উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ (খসড়া) : পর্যালোচনা ও সুপারিশ” শীর্ষক এই ভার্চ্যুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
টিআইবি বলেছে, ইন্টারনেটভিত্তিক জীবনব্যবস্থায় ব্যক্তিগত তথ্যকে বলা হয় ইন্টারনেটের জ্বালানি বা মুদ্রা। এ প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে আইন তৈরির উদ্যোগ প্রশংসনীয়। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার (আঙ্কটাড) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৩৭টি দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বা তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কে দেশীয় আইন রয়েছে। আঙ্কটাডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ ধরনের আইন নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তাড়াহুড়ো করার কোনো সুযোগ নেই। অংশীজনদের নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার পরই আইনটি চূড়ান্ত করা উচিত হবে।
টিআইবি প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর ধারাগুলো চিহ্নিত করেছে। তারা বলেছে, আইনটি এভাবে পাস হলে তা একটি কালো আইনে পরিণত হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দেয়ার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু খসড়াটি যেভাবে রয়েছে, সেভাবেই পাস হলে সুরক্ষার বদলে ব্যক্তিগত তথ্য সরকারের বা প্রশাসনের হাতে চলে যাওয়া ও অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি হবে।
সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব হবে।
ইউনিভার্সিটি অব মালয়া, মালয়েশিয়ার ল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজিসের শিক্ষক এরশাদুল করিম বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোয় ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় আইন রয়েছে। এসব আইনে ব্যক্তিগত তথ্য কী, তার ব্যাখ্যা আছে, কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রস্তাবিত এ আইনের খসড়ায় ব্যক্তিগত তথ্য কী, তারই কোনো ব্যাখ্যা নেই।
আইনে বিভিন্ন শব্দের অস্পষ্ট উপস্থিতির পাশাপাশি আলোচকেরা ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিকে সীমাহীন ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫ ধারায় এ ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কথা বলা আছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ডেটা/উপাত্তের সুরক্ষার একক ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে এই এজেন্সিতে।
টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস) শেখ মুহাম্মদ মনজুর-ই-আলম তার উপস্থাপনায় বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির এ ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকার ও গোপনীয়তার যে অধিকার মানুষকে দিয়েছে, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, উপাত্ত সুরক্ষা কার্যালয় এ আইনের অধীন কার্যসম্পাদনের প্রয়োজনে যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
মনজুর বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কাজ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত করা, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় দেখভাল করা। অন্যদিকে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের উদ্দেশ্য, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সীমিত করা। ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া কোনো তথ্য যেন ব্যবহার না করা হয়, তা নিশ্চিত করা। এ দুটির উদ্দেশ্যে কোনো মিল নেই। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এ দায়িত্ব পালন করছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন।
মনজুর আরও বলেন, একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কাজ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার, অন্যদিকে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের মূল উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নেয়া দরকার। তাহলে সহজেই বোঝা যাবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির সীমাহীন ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে একটি কালো আইনে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন কোনো কমিশনকে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তিনি।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের বলেন, কমিশনগুলোর কাজ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাদের জবাবদিহির একটা ব্যাপার আছে। সে কারণেই তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশনের প্রস্তাব করছেন।
টিআইবি সভায় বলেছে, খসড়ায় ব্যক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রককে অতিমানব বলে ধরে নেয়া হয়েছে। এ আইনের বিধান বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কারিগরি ও আর্থিক দায় নেয়ার ভার তাদের। প্রস্তাবিত আইনের ধারা ২-এ নিয়ন্ত্রক ও প্রক্রিয়াকারী—শব্দগুলোর সংজ্ঞায় সরকারি কর্তৃপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
টিআইবি বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের সরকারি অফিসে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ভুগছেন। সরকারি কর্তৃপক্ষ বর্তমান বাস্তবতায় এ বিধানগুলো পালন করতে পারবে না, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
এর বাইরেও অতিমাত্রায় বিধিনির্ভরতা, অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ প্রস্তাবনা এবং ব্যক্তি শব্দের সঠিক ব্যবহার অপব্যবহারের পথ করে দেবে বলে মন্তব্য করেছে টিআইবি। কারণ, এতে করে কৃষক, দিনমজুর, ভিক্ষুক বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি—সবাইকে এ আইনের বিধানগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং তাদের কারিগরি জ্ঞান থাকতে হবে। এর বাইরেও টিআইবি প্রশ্ন তুলেছে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠানেরও কি এ বিধান পালনের সক্ষমতা আছে?