নাজাতের দশকে নবিজীর (সা.) বিশেষ আমল
রমজান আমলের মাস। ইবাদত-বন্দেগির মাস। গুনাহ মাফের মাস। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাস। লাইলাতুল কদর পাওয়ার মাস। তাই রোজাদারের শেষ দশক ও লাইলাতুল কদর পাওয়ার প্রচেষ্টার প্রহরগুলো কাটুক নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ আমলে। কী সেই বিশেষ আমল?
রহমতের মাস রমজান এলেই মানুষ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল করা, দান-সাদকা ও ভালো কাজ করার মানসিকতা বেড়ে যায়। আর শেষ দশকে এ আমলের পরিমাণ আরও বেশি বেড়ে যায়। নবিজীও শেষ দশকে বেশি ও বিশেষ আমল করতেন এবং সাহাবা ও পরিবার পরিজনকে করতে বলতেন।
আল্লাহর দেওয়া মাসগুলোর মধ্যে রমজান অতি মর্যাদার ও সম্মানের। এ মাসের রোজা, তারাবিহ ও লাইলাতুল কদর পেলেই বিগত জীবনের গোনাহ থেকে মুক্তি পাবে মুমিন। তাছাড়া এ মাসের শেষ দশকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ আমলে দিন-রাত অতিবাহিত করবেন রোজাদার। তাহলো-
বেশি ইবাদত করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাস এলেই ইবাদতের মাত্রা খুব বেশি বাড়িয়ে দিতেন। রাত জেগে আমল করতেন। বিশেষ করে শেষ দশক। হাদিসে এসেছে-
১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (রমজানের) শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা এত বেশি বাড়িয়ে দিতেন, যেমনটি অন্য সময় করতেন না।’ (আস সুনানুল কুবরা, মুসলিম)
২. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আরও বর্ণনা করেন, ‘যখন রমজানের শেষ ১০ রাত আসত, তখন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমরে কাপড় বেঁধে (ইবাদত-বন্দেগিতে) নেমে পড়তেন এবং রাত জেগে থাকতেন। আর পরিবার-পরিজনকেও তিনি জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি)
রাতের পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে তোলা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে নিজে যেমন ইবাদত করতেন তেমনি নিজের পরিবার-পরিজনকেও তিনি রাতের ইবাদতে মনোযোগী হতে জাগিয়ে দিতেন। আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনা থেকেই তা সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেন-
‘রমজানের শেষ দশক এলেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর শক্ত করে বেঁধে নিতেন এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারি)
তাহাজ্জুদে গুরুত্ব দেওয়া
রাতের নামাজ তাহাজ্জুদ পড়তে অন্যদের জাগিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তেমন জোর দেওয়া না হলেও প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ মেয়ে ফাতেমা তাহাজ্জুদ পড়তে ডেকেছেন মর্মে হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়-
হজরত আলি ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাতে তাঁর কন্যা ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে এসে বলেন, ‘তোমরা কি নামাজ আদায় করছ না?’ (বুখারি)
ইতেকাফ করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। এ দশকের ইতেকাফের মর্যাদা ও গুরুত্বও অনেক বেশি। কারণ এ দশকেই রয়েছে লাইলাতুল কদর। আর ইতেকাফকারীদের জন্য হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এ রাত পাওয়া খুবই সহজ।
মুমিন মুসলমান রোজাদারের জন্য শেষ দশকে ইতেকাফ করা সুন্নাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে আমৃত্যু ইতেকাফ করেছেন। এরপর তাঁর স্ত্রীরাও ইতিকাফ অব্যাহত রেখেছেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
এ কারণেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণে সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তীগণ শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন।
লাইলাতুল কদর তালাশ করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। তারপর আমার প্রতি ওহি নাজিল করে জানানো হলো যে, তা শেষ ১০ দিনে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে। তারপর মানুষ (সাহাবায়ে কেরাম) তাঁর সঙ্গে ইতেকাফে শরিক হয়।’ (মুসলিম)
সুতরাং রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক রাতই ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করা জরুরি। কেননা এ রাতগুলোর মধ্যেই রয়েছে লাইলাতুল কদর। এ রাত প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমের একাধিক সুরা ও আয়াতে বিশেষ ফজিলত ঘোষণা করা হয়েছে-
‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে (লাইলাতুল কদর)। আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতারা এবং রুহ (জিবরিল আ.) তাদের প্রতিপালকের আদেশক্রমে অবতীর্ণ হয়। সেই রাতে ফজর হওয়া পর্যন্ত শান্তিই শান্তি।’ (সুরা কদর : আয়াত ১-৫)
অন্য আয়াতে বিষয়টি আর সুস্পষ্ট করেছেন-
حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ – إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ – فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ – أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ – رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
‘হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে (কুরআন) এক বরকতময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা দুখান : আয়াত ১-৬)
বিশেষ করে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কথা স্পষ্ট করে বলেছেন বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে-
‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর।’ (বুখারি)
লাইলাতুল কদরের দোয়া পড়া
রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর পেলেই এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার কথা বলেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একবার আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলে দিন, আমি যদি লাইলাতুল কদর কোন রাতে হবে তা জানতে পারি, তাতে আমি কী (দোয়া) পড়বো?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বলবে-
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, রমজানের বাকি দিনগুলো প্রিয় নবির শেখানো পদ্ধতি অতিবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা পাওয়ার চেষ্টা করা। কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমল ও ইবাদত করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শেষ দশকের বিশেষ বাকি দিনগুলোতে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমল করার তাওফিক দান করুন। লাইলাতুল কদর পেতে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।