নবিজী (সা.) যেভাবে ‘লাইলাতুল কদর’ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন
পুরো রমজান মাসে একটি রাত ‘লাইলাতুল কদর’। তা আবার রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে হয়ে থাকে। কিন্তু এ মর্যাদার রাত কোনটি? মানুষ কীভাবে এটি নির্ণয় করবে? নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মর্যাদার রাত পেতে কী করেছিলেন? এ রাতের ইবাদত সম্পর্কেই বা কী নসিহত করেছিলেন?
রমজান রোজাদারের তাকওয়া অর্জনের মাস। এ মাসের রোজা, তারাবি, তাহাজ্জুদ, ইফতার, সেহরি, দোয়া-দরূদসহ লাইলাতুল কদর পাওয়ার সব প্রচেষ্টার একটাই উদ্দেশ্য বিগত জীবনের গুনাহ থেকে মাফ পাওয়া; আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে পাকে এভাবে ঘোষণা দিয়েছেন-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, মুসলিম)
গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া ছাড়াও এ মাসে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে হেদায়েত দান করেন। যা মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘রমজান হলো সেই মাস, যাতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সঠিক পথের যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশক এবং (ন্যায় ও অন্যায়ের) পার্থক্য বিধানকারী।’ (সুরা কুরআন : আয়াত ১৮৫)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘লাইলাতুল কদর’-এর সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ উল্লেখ করেন নাই। তবে তিনি লাইলাতুল কদর পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সাধনা করেছেন, ইতেকাফে বসেছেন। সাহাবা, পরিবার-পরিজনকে ইতেকাফ ও রাত জাগরণ করতে বলেছেন, রাত জাগরণ করিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর উম্মাহাতুল মুমিনিনগণও ইতেকাফ করেছেন। উদ্দেশ্য একটাই মর্যাদার রাত ‘লাইলাতুল কদর’ পাওয়া। তবে নবিজী লাইলাতুল কদর পেতে যে রীতি অনুসরণ করেছেন। তাহলো-
১. হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
আমি কদরের রাত পেতে (রমজানের) প্রথম দশদিন ইতেকাফ করলাম।
এরপর (রমজানের) মধ্যবর্তী দশদিন ইতেকাফ করলাম।
অতপর ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হল যে-
তা (লাইলাতুল কদর রমজানের) শেষ দশ দিনে (নিহিত)।
সুতরাং তোমাদের যে ইতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন (রমজানের শেষ দশকে) ইতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সঙ্গে ইতেকাফ করলো।’ (মুসলিম)
এ রাতের মর্যাদা এত অধিক যে, তা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ – وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ؕ – لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهۡرٍ – تَنَزَّلُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ الرُّوۡحُ فِیۡهَا بِاِذۡنِ رَبِّهِمۡ ۚ مِنۡ کُلِّ اَمۡرٍ – سَلٰمٌ ۟ هِیَ حَتّٰی مَطۡلَعِ الۡفَجۡرِ
‘নিশ্চয়ই আমি একে নাজিল করেছি শবে কদরে। (হে রাসুল!) শবে কদর সম্পর্কে আপনি জানেন কি? শবে কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে (এ রাতে) প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরিল আমিন) তার পালনকর্তার নির্দেশে অবতীর্ণ হয়। এটা নিরাপদ, শান্তি। যা ফজর হওয়ার সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সুরা কদর)
২. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শেষ দশ দিন ইতেকাফ করেছেন।’ (বুখারি)
উল্লেখ্য, লাইলাতুল কদরের সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ রাতগুলো যথা ক্রমে তুলে ধরা হলো-
প্রথম : ২৭ তারিখের সম্ভাবনা বেশি। তারপর যে বেজোড় রাতগুলোর সম্ভাবনা বেশি তাহলো-
দ্বিতীয় : ২৫ রমজানের রাত।
তৃতীয় : ২৯ রমজানের রাত।
চতুর্থ : ২৩ রমজানের রাত।
পঞ্চম : ২১ রমজানের রাত।
৩. লাইলাতুল কদর পাওয়ার নিয়েতে শেষ দশকের প্রতি রাতের দোয়া
এ রাতটি পাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের নিয়তে মসজিদে ইতেকাফে অতিবাহিত করতেন। যাতে কোনোভাবে কদরের রাত থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। কদরের রাতের বিশেষ দোয়া প্রসঙ্গে হাদিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা রয়েছে। আর তাহলো-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একবার আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলে দিন, আমি যদি লাইলাতুল কদর কোন রাতে হবে তা জানতে পারি, তাতে আমি কী (দোয়া) পড়বো?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বলবে-
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)
হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, রমজানের শেষ দশকেই লাইলাতুল কদর নিহিত। সুতরাং লাইলাতুল কদর পেতে রমজানের শেষ দশকে তা সন্ধান করা। রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার বিকল্প নেই।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে লাইলাতুল কদর পেতে আজীবন চেষ্টা সাধনায় আত্মনিয়োগ করার তাওফিক দান করুন। লাইলাতুল কদরের নিয়তে বেজোড় রাতগুলোতে না ঘুমিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।