গত এক দশক ধরে স্বাস্থ্যখাতের লুটপাট ,পানামা পেপারসের মিঠু….
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, স্বাস্থ্যখাতের লুটপাটকা-ে যে নাম আলোচনার শীর্ষে। শুধু স্বাস্থ্যখাতেই নয়, শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুর্নীতি-অপকর্মে তার জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যখাতে গত এক দশক ধরে যেসব দুর্নীতি-অপকর্ম, হরিলুট হয়েছে তার সিংহভাগের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। গত সেপ্টেম্বরে সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর গা-ঢাকা দেন তিনি। অভিযান শুরু হওয়ার পর পরই তড়িঘড়ি বিদেশ পালিয়ে যান। কিন্তু বিদেশে গেলেও স্বাস্থ্যখাতে তার তৎপরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
দেশের ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট এবং অনলাইন গণমাধ্যমসমূহে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর দুর্নীতি নিয়ে অসংখ্যবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওইসব সংবাদে দুর্নীতির জাজ্বল্য তথ্যপ্রমাণও তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী পানামা পেপারস কেলেংকারিতে নাম আসার পর তার বিরুদ্ধে মামলাও করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এছাড়া বিভিন্ন সময় অনেকগুলো তদন্ত হয়। তদন্তে সত্যতাও পাওয়া যায়। কিন্তু মিঠু বরাবরই অর্থের জোরে পার পেয়ে গেছেন।
গোটা স্বাস্থ্যখাতেই রয়েছে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর দৌরাত্ম।
বহুল আলোচিত আবজালসহ চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের প্রায় সবারই দুর্নীতিতে হাতেখড়ি মিঠুর হাত ধরে। তিনি যে প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তা পানামা পেপারস কেলেংকারি থেকেই স্পষ্ট। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের তথ্য প্রকাশিত হয় পানামা পেপারসে ২০১৬ সালে। এসব তথ্য নিয়ে দেশে দেশে হইচই পড়ে যায়। সেই কেলেংকারির সূত্র ধরেই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এবং তার মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। পানামা পেপারসে বাংলাদেশের যে ক’জনের নাম প্রকাশিত হয়েছে তারমধ্যে মিঠু অন্যতম।
সূত্রমতে, মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নামে-বেনামে কমপক্ষে দেড় ডজন প্রতিষ্ঠান গোটা স্বাস্থ্যখাত দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধুমাত্র লেক্সিকান মার্চেন্ডাইজার নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে। বনানীতে এইটির অফিস। এছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবগুলোর ঠিকানাই ভুয়া। অথচ এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা দেয়া হয়েছে। যেমন ফিউচার ট্রেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেখানো হয়েছে ৪/৩ কমলাপুর বাজার রোড, ঢাকা। মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানাকে এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক হিসেবে দেখানো হয়। বস্তুত ওই ঠিকানায় ফিউচার ট্রেড নামে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কখনো ছিল না, এখনো নেই। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে মুগদা ৫০০ শয্যা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহের শ’ শ’ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া যেসব কার্যাদেশের বিপরীতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে সেগুলোও অত্যন্ত নি¤œমানের এবং দর ধরা হয়েছে অত্যন্ত আকাশচুম্বী।
শুধু ফিউচার ট্রেডই নয়, এরকমের অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে মিঠু হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সিআর মার্চেন্ডাইজ, এলআর এভিয়েশন, জিইএফ এন্ড ট্রেডিং, ট্রেড হাউজ, মেহরবা ইন্টারন্যাশনাল, ক্রিয়েটিভ ট্রেড, লেক্সিকান আইটি, লেক্সিকান মার্চেন্ডাইজার, লেক্সিকান মার্চেন্ডাইজ এন্ড টেকনোক্রেট, টেকনো ট্রেড, বেলএয়ার এভিয়েশন, জিইএস এন্ড ট্রেডিং, হ্যাভ ইন্টারন্যাশনাল, লেসিকন হসপিটালিটি, নর্থ টেক এলএলসি- মিঠুর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র লেক্সিকান মার্চেন্ডাইজার নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা অনুযায়ী অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। এইটির ঠিকানা বনানীর ‘এ’ ব্লকের ২৫/এ রোডের ৫/এ বাড়ি। এছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটির ঠিকানা দেয়া হয়েছে ১৪৩ মালিবাগ বাজার রোড, কোনোটি চট্টগ্রামস্থ আগ্রাবাদ সিডিএ, কোনোটি ঢাকার ৩৯ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোড।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই ঠিকানায় এ রকমের প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই নেই। অথচ প্যাড সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের নামে সারাদেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ব্যাপকহারে লুটপাট চালানো হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক লুটপাটের তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে গণমাধ্যমগুলো কখনো মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে ‘ডগফাদার’ কখনো ‘মাফিয়া ডন’ নামে আখ্যায়িত করেছে।
জানা গেছে, সারাদেশে স্বাস্থ্যখাতের যেসব প্রতিষ্ঠানে মিঠু ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে তারমধ্যে রয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, গাজীপুরস্থ শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকাস্থ পঙ্গু হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতাল, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল প্রভৃতি। মিঠু সারাদেশের যেসব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মালামাল সরবরাহের নামে ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে তারমধ্যে এগুলো অন্যতম।
সূত্রমতে, শুধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালই নয়, পুরো স্বাস্থ্যখাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্যখাত। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকায় তিনি বিদেশেও গড়ে তুলেছেন বিত্ত-বৈভব ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটান। কখনো তা অর্থের মাধ্যমে, আবার কখনো হুমকি-ধামকির মাধ্যমে। মিঠুর সিন্ডিকেটের মর্জিমতো কাজ না করে উপায় নেই- বলছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি হাসপাতালের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। কারণ, এই সিন্ডিকেটের লুটপাটসহ নানা রকমের অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে অনেক উচ্চ পর্যায়ের যোগসাজশ রয়েছে। টেন্ডার কারসাজিতে পটু এই সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে সরকারি সিনিয়র পর্যায়ের ডাক্তার, প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাড়াও বাইরের কিছু দালাল ব্যবহার করা হয়। এরা সরকারি যে হাসপাতাল বা যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আগে বোঝাপড়া করে নেয়। টেন্ডার যেভাবেই আহ্বান করা হোক না কেন, যে বা যারাই টেন্ডারে অংশ নিক না কেন কাজ তাদেরই দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন ঠিকানায় মিঠুর নামে-বেনামে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান থাকলেও সব কাজ চলে বনানীর এক অফিস থেকেই। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন হাসপাতালের প্যাডও রয়েছে বনানীস্থ মিঠুর এই অফিসে। মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতালের মালামালের চাহিদাও তৈরি করা হয় এখানে।
টেন্ডার স্পেসিফিকেশন, এমনকি টেন্ডার সিডিউলও তৈরি করা হয় মিঠুর অফিসে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কর্মকর্তারা, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাও এ অফিসে প্রায়ই যাতায়াত করেন। মন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদেরও যাতায়াত রয়েছে এই অফিসে।