রোজা পালনে কোরআনের বিশেষ নির্দেশনা
রোজা ইসলামের ফরজ বিধান। আল্লাহ তাআলা রমজান মাসজুড়ে রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে রোজাদারের জন্য আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন; তাহলো- ‘দিনের বেলায় হালাল বস্তু খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আবার স্বামী-স্ত্রীও মেলামেশা থেকেও বিরত থাকবে।’ এমনকি যারা রমজান মাসে ইতেকাফ করবে; সেসব স্বামী-স্ত্রীও মেলামেশা করতে পারবে না। এসবই আল্লাহর নির্দেশ।
রোজার বিধান আবশ্যক হওয়ার আগে রোজা রাখার ব্যাপারে ছাড় ছিলো। কেউ চাইলে রোজা রাখার পরিবর্তে ফিদইয়া দিতে পারতো। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহর সে ঘোষণা ছিল এমন-
وَ عَلَی الَّذِیۡنَ یُطِیۡقُوۡنَهٗ فِدۡیَۃٌ طَعَامُ مِسۡکِیۡنٍ ؕ فَمَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا فَهُوَ خَیۡرٌ لَّهٗ ؕ وَ اَنۡ تَصُوۡمُوۡا خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
‘আর যারা রোজা রাখার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রোজা রাখতে চায় না (যারা রোজা রাখতে অক্ষম), তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। পরন্তু যে ব্যক্তি খুশীর সঙ্গে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তোমরা রোজা রাখ, তাহলে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণের; যদি তোমরা উপলব্ধি করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৪)
রোজা রাখার নির্দেশ
আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে রমজান মাসে যেমন রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তেমনি রোজায় করণীয় কী হবে তাও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। রোজার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ ঘোষণা দেন-
فَمَنۡ شَهِدَ مِنۡکُمُ الشَّهۡرَ فَلۡیَصُمۡهُ
‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।‘ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
রমজান মাস। এ মাস পেলেই মুমিন মুসলমানের জন্য রোজা রাখা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। কোরআনুল কারিমে তিনি এ ঘোষণাই দিয়েছেন- ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি রমজান মাসে উপস্থিত থাকবে, বর্তমান থাকবে, তার উপর রমজান মাসের রোজা রাখা আবশ্যক কর্তব্য।’
আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের এ আয়াত নাজিল করার মাধ্যমে সেই ফিদইয়া দেওয়ার বিধান রহিত করে দেন। রোজা পালনকে ঈমানদারদের জন্য আবশ্যক করে দেন।
রোজায় খাওয়া ও পান করা
রমজান মাসে নির্ধারিত একটি সময় খাওয়া ও পান করা নিষেধ। ভোর রাত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো হালাল খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الۡخَیۡطُ الۡاَبۡیَضُ مِنَ الۡخَیۡطِ الۡاَسۡوَدِ مِنَ الۡفَجۡرِ۪ ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ
‘আর আহার করো ও পান করো যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। এরপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)
এ নির্দেশনার মানে হলো, রাতে খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে কিন্তু ভোর রাত থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত সারাদিন খাবার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে রোজা পূর্ণ করতে হবে। আর এটিই মহান প্রভুর নির্দেশ।
রোজায় স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা
রোজার বিধান আসার পর স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা হারাম ছিল। এরপর ইফতারের পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রী সহবাস করাকে অনুমতি দেওয়া হয়। একবার শয্যাগ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ সবকিছু (খাবার গ্রহণ ও স্ত্রী সহবাস) হারাম হয়ে যেতো। এতে কোনো কোনো সাহাবি এ ব্যাপারে অসুবিধায় পড়েন।
হজরত কায়েস ইবনে সিরমাহ আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে ইফতারের সময় ঘরে এসে দেখেন, ঘরে খাওয়ার মতো কোনো কিছুই নেই। স্ত্রী বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি কোথাও থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনার চেষ্টা করি। স্ত্রী যখন কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে ফিরে এলেন তখন সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইফতারের পর ঘুমিয়ে পড়ার দরুন খানা-পিনা তার জন্য হারাম হয়ে যায়। ফলে পরদিন তিনি এ অবস্থাতেই রোজা রাখেন। কিন্তু দুপুর বেলায় শরীর দুর্বল হয়ে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যান।’ (বুখারি)
অনুরূপভাবে কোনো কোনো সাহাবি গভীর রাতে ঘুম ভাঙার পর স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়ে মানসিক কষ্টে পড়ে যান। ফলে এসব ঘটনার পর এ আয়াত নাজিল হয়। যাতে আগের হুকুম বাদ দিয়ে নতুন করে- ‘সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু করে সুবহে-সাদেক তথা ভোর রাত পর্যন্ত খাওয়া ও পান করার পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশাকে বৈধ করা হয়। এ বিষয়টি আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে এভাবে ঘোষণা দেন-
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَآئِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ فَالآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُواْ مَا كَتَبَ اللّهُ لَكُمْ وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদের ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। এরপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করো এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরণ কর। আর খাও ও পান করো যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। এরপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)
এ নির্দেশনার হেকমত হলো- যারা আল্লাহর হুকুম মেনে হালাল কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারে, নিঃসন্দেহে তারা দুনিয়ার সব হারাম কাজ থেকেও নিজেদের বিরত রাখতে সক্ষম।
রমজান মাসের এ রোজা রাখার ফলে মানুষ শয়তানের সব প্ররোচনা থেকে মুক্তি পায়। রোজা যৌন উত্তেজনাকে প্রশমিত করে। রোজা রাখার ফলে গরিব-দুঃখী মানুষ না খাওয়ার কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাদের প্রতি রোজাদারের হৃদয় ও মন আকৃষ্ট হয়। তাদের ক্ষুধার কষ্ট লাগবে রোজাদারের দান-খয়রাত করার মানসিকতা তৈরি হয়।
রোজার অন্যতম শিক্ষা
রোজা সময়ের যথাযথ ব্যবহার শেখায়। রমজানের প্রতিটি ইবাদতই সময়ের সঙ্গে জড়িত। যার ফলে মানুষ নিয়ম-শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হয়। রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর নির্দেশ পালনের মানসিকতা তৈরি করে দেয়। নফসের দাসত্ব ও পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, তারা দুনিয়ার ধনি-গরিব সব মানুষের প্রতি সদয় থাকে।
রমজান ঐক্যের শিক্ষা দেয়। দুনিয়ার সব মুসলমানকে এক কাতারে সামিল করে দেয় রমজান। ধনি-গরিব কিংবা আমির-ফকিরে কোনো বৈষম্য থাকে না। কেননা ইফতার-সাহরি গ্রহণে কেউই নিজেদের মধ্যে উঁচু-নিচু ভাব নেয় না। করে না সময়ের ব্যবধান।
রমজান রোজা পালনের পাশাপাশি তারাবি-তাহাজ্জুদ পড়া এবং ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষকে মসজিদমুখী করে গড়ে তোলে। মসজিদ হয়ে ওঠে রোজাদারের আত্মার আস্তানা। হৃদয়ে কাবা। আর মসজিদমুখী পরিবেশের কারণে রোজাদারের মন্দ কাজের প্রতি আগ্রহ থাকে না বললেই চলে। যা রমজান পরবর্তী মাসগুলোতে চলতে থাকে।
রোজার বিধান পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ পালনে একনিষ্ঠ হয় রোজাদার। আর এভাবেই মানুষ মন্দ কাজ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর ভয় অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়।
তাহলে মুমিন কেন রোজা রাখবে?
মহান আল্লাহর মহাঅনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার ওপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পর্যাযে আদেশ-নিষেধ, উপদেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে ফরজ তথা আবশ্যকীয় এবং হারাম তথা বর্জনীয় কাজ। অনুরূপ একটি ফরজ হচ্ছে রমজান মাসের সিয়াম বা রোজা পালন করা। আল্লাহর হুকুমে দুনিয়া সব খারাবি থেকে নিজেদের বিরত রাখার মাধ্যমে তাকওয়া ও পরহেজগারি অর্জন করার জন্যই রোজা রাখবে মুমিন মুসলমান।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে রমজানের রোজা পালনের মাধ্যমে কুরআনের ঘোষণা তাকওয়া অর্জন করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়া পরকালের যাবতীয় নেয়ামতে জীবন পরিপূর্ণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।