রোজার প্রতিদান ও কাফফারা
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে অপর জুমা, এক রমজান থেকে অপর রমজান মধ্যবর্তী সময়ের জন্য (গুনাহ থেকে) কাফফারাস্বরূপ। যদি কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয়।’ (মুসলিম)
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে রমজানের রোজা রাখলো, তার সীমারেখা ঠিক রাখলো, আর যা থেকে বিরত থাকা দরকার তা থেকে বিরত থাকলো, তার আগের সব পাপ মোচন করা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু ইয়ালা, বায়হাকি, ইবনে হিব্বান)
রোজার প্রতিদান
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন-
لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ وَ الصَّوْمُ لِىْ وَ اَنَا اَجْزِىْ بِه
সব আমলের কাফফারা আছে; আর রোজা হচ্ছে আমার জন্য; আমি তার প্রতিদান দেবো।’ (বুখারি, মুসনাদে আহমাদ)
২. মুসনাদে আহমদে এসেছে, ‘প্রত্যেক আমলের কাফফারা আছে; আর রোজা আমার জন্য; আমি রোজার প্রতিদান দেবো।’
৩. অন্য বর্ণনায় এসেছে, প্রত্যেক আমলের কাফফারা তবে রোজা ছাড়া। রোজা আমার জন্য; আমি তার প্রতিদান দেবো।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, মুসনাদে আহমাদ)
রোজা ফেতনা-পরীক্ষার কাফফারা
সব কিছুর প্রতিদানই আছে মহান রবের কাছে। কোরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহ এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন-
১. اِنَّمَاۤ اَمۡوَالُکُمۡ وَ اَوۡلَادُکُمۡ فِتۡنَۃٌ ؕ وَ اللّٰهُ عِنۡدَهٗۤ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ
‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর কাছেই মহান প্রতিদান।’ (সুরা তাগাবুন : আয়াত ১৫)
২. وَ نَبۡلُوۡکُمۡ بِالشَّرِّ وَ الۡخَیۡرِ فِتۡنَۃً ؕ وَ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ
‘আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে (ফেতনার ব্যাপারে) পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩৫)
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, প্রাচুর্য-দারিদ্র্য, হালাল-হারাম, পাপ-পূণ্য এবং হেদায়েত ও গোমরাহির মাধ্যমে পরীক্ষা করবে।’ (ইবনে কাসির)
ফেতনা/পরীক্ষা কাফফারা সম্পর্কে নবিজীর সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল এমন-
হজরত হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি তাঁকে (নবিজীকে) বলতে শুনেছি, ‘ব্যক্তির ফেতনা/পরীক্ষা তার পরিবার-পরিজনে, মাল-সম্পদে ও তার প্রতিবেশির মধ্যে। যারা কাফফারা হয়- নামাজ, রোজা ও সাদকা।’ (বুখারি, মুসলিম)
শিক্ষা ও মাসায়েল
১. নবিজীর হাদিস থেকে প্রমাণিত- রোজা গুনাহের কাফফারা। রোজা শুধু কাফফারাই নয় বরং সঙ্গে অতিরিক্ত সওয়াবও আছে। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য রোজা রাখলে মিলবে রোজার সব ফজিলত।’ (ফাতহুল বারি)
২. ইমাম নববি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘কখনো বলা হয়- অজু যদি গুনাহের কাফফারা হয় তবে নামাজ কিসের কাফফারা? আর নামাজ যদি কাফফারা হয় তবে- জামাতে নামাজ, রমজানের রোজা, আরাফার রোজা, আশুরার রোজা এবং ফেরেশতাদের আমিন বলার সঙ্গে বান্দার আমিনের মিল কীসের কাফফারা? কারণ এসব আমল সম্পর্কে বলা আছে যে, এগুলো কাফফারা।
ইসলামিক স্কলার ও আলেমগণ জানিয়েছেন, ‘এসব আমল কাফফারার যোগ্য; যদি কাফফারা করার জন্য ছোট গুনাহ থাকে। তাহলে এর দ্বারা নেকি লেখা হয় ও মর্যাদা বাড়ানো হয়। আর যদি কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয় তবে আশা করি এ সবের কাফফারায় তা হালকা হবে।’ (শারহুন নববি)
৩. রোজা রাখার ফলে পাপ বা গুনাহ মাফ হয়।
৪. রোজার এসব ফজিলত সেও পাবে; যে রোজা বিনষ্টকারী বস্তু থেকে নিজের রোজাকে হেফাজত করবে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে রমজানের রোজা রাখলো, তার সীমারেখা ঠিক রাখলো, আর যা থেকে বিরত থাকা দরকার তা থেকে বিরত থাকলো, তার আগের সব পাপ মোচন করা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু ইয়ালা, বায়হাকি, ইবনে হিব্বান)
শুধু তা-ই নয়,
৫. কল্যাণ-অকল্যাণ উভয় দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করা হয়; তাহলো- অধিক সম্পদ ও নেয়ামত। আর অকল্যাণের পরীক্ষা- বিপদ-আপদ, দুঃখ-বেদনা, রোগ-ব্যাধি।
৬. সন্তান ও সম্পদ মানুষের জন্য পরীক্ষা। কারণ মানুষ তাদের ভালোবাসায় আল্লাহর হক নষ্ট করে। এটি পরকালে আজাবের কারণ হবে। ইসলামি শরিয়তের আলোকে তাদের প্রতি মানুষের দায়িত্ব হলো- তাদের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া; ভরণ-পোষণ দেওয়া। এ সবে ত্রুটি করলেও পরকালে রয়েছে আজাব।
৭. পাপ ও নাফরমানি সবচেয়ে বড় ফেতনা। মন্দ লোকরা যে কোনো সময় এ ফেতনায় জাড়িয়ে পড়ে কিন্তু কখনো কখনো ভালো মানুষও এ ফেতনায় জড়িয়ে পরতে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন-
اِنَّ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا اِذَا مَسَّهُمۡ طٰٓئِفٌ مِّنَ الشَّیۡطٰنِ تَذَکَّرُوۡا فَاِذَا هُمۡ مُّبۡصِرُوۡنَ
‘নিশ্চয়ই যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ২০১)
وَ الَّذِیۡنَ اِذَا فَعَلُوۡا فَاحِشَۃً اَوۡ ظَلَمُوۡۤا اَنۡفُسَهُمۡ ذَکَرُوا اللّٰهَ فَاسۡتَغۡفَرُوۡا لِذُنُوۡبِهِمۡ ۪ وَ مَنۡ یَّغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ اِلَّا اللّٰهُ ۪۟ وَ لَمۡ یُصِرُّوۡا عَلٰی مَا فَعَلُوۡا وَ هُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ
‘আর যারা কোনো অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, এরপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চায়। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে ? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৩৫)
৮. কোনো গুনাহে যে বার বার লিপ্ত হয়; তার উচিত বেশি বেশি সওয়াবের কাজ করা। কেননা নেক কাজ গুনাহ মুছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ ؕ اِنَّ الۡحَسَنٰتِ یُذۡهِبۡنَ السَّیِّاٰتِ ؕ ذٰلِکَ ذِکۡرٰی لِلذّٰکِرِیۡنَ
‘আর তুমি নামাজ কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে এবং রাতের প্রথম অংশে। নিশ্চয়ই ভালকাজ মন্দকাজকে মিটিয়ে দেয়। এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ।’ (সুরা হুদ : আয়াত ১১৪)
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বেশি বেশি নেক কাজ মানুষকে গুনাহ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। এরপর আল্লাহ মানুষকে তার নেক আমলের কারণে তাওবাহ কবুল করেন।
৯. এসব আমল দ্বারা বান্দার হক মাফ হয় না; ছোট বা বড় নেক আমলের কারণেও কারো হক মাফ হয় না। বরং তা থেকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে। যথাযথ ব্যক্তি থেকে মাফ নিতে হবে।
সুতরাং পবিত্র রমজানের রোজা পালনকারী মুমিন মুসলমানের উচিত, রমজানের রাত-দিন হারাম কথা, গিবত, পরনিন্দা ও হাত, মুখ, পা, চোখের হারাম কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখা। তবেই রমজানের রোজা হবে পাপ মোচনকারী। তখনই আল্লাহ তাআলা রোজাদারকে দান করবেন রোজার প্রতিদান।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহক সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। রোজাকে নিজেদের পাপ মোচনকারী আমল হিসেবে কবুল করুন। আমিন।