পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের পূর্ণ মেয়াদ হয় না কেন?

0

১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ভেঙ্গে জন্ম নেয় দুটি দেশ পাকিস্তান ও ভারত। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দুটি দেশ হাঁটছে দুই পথে। যেখানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছে ভারত। সেখানে বরাবরই সেনাবাহিনীর পদলেহন করে চলেছে পাকিস্তান। ফলাফল হিসেবে নতুন এক রেকর্ড গড়েছে দেশটি। এখন পর্যন্ত দেশটিতে কোন প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারেনি।

পাকিস্তানের সেই লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে সর্বশেষ ইমরান খান, কেউই নিজের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। হয় নিহত হয়েছেন, নয়ত ক্ষমতাচ্যুত। বিশ্বের আর কোনো দেশে এই রেকর্ড নেই। এমনটাই জানিয়েছে পাকিস্তানের গণমাধ্যম জিও টিভি।

পাকিস্তান সরকারের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে জিও টিভি দেশটিতে কোন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে ক্ষমতা হারিয়েছেন, কার মেয়াদ কতদিন ছিল, সেই হিসাব দেখিয়েছে। ব্রেকিংনিউজের পাঠকদের জন্য সেই চিত্রটি তুলে ধরা হলো:

লিয়াকত আলী খান: পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে নির্বাচিত হন। রাওয়ালপিন্ডিতে ১৬ অক্টোবর ১৯৫১ সালে তাকে হত্যা করার আগে মাত্র চার বছর দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন।

খাজা নাজিমুদ্দিন: লিয়াকত আলী খান নিহত হওয়ার একদিন পর ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর খাজা নাজিমুদ্দিন দায়িত্ব নেন। ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর দাঙ্গার কারণে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ নাজিমুদ্দিনকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। পরেরটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরপর ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল নাজিমুদ্দিনকে অপসারণ করেন।

মোহাম্মদ আলী বগুড়া: মোহাম্মদ আলী বগুড়ার গভর্নর জেনারেল ১৯ এপ্রিল ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। আঞ্চলিক ইস্যুতে দ্বন্দ্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবের কারণে ১২ আগস্ট ১৯৫৫ সালে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর-জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা তাকে অপসারণ করেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র ২ বছর।

চৌধুরী মোহাম্মদ আলী: চৌধুরী মুহাম্মদ আলীকে মির্জা কর্তৃক ১২ আগস্ট ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয়। আলী ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের জন্য আজও সুপরিচিত। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আলী তার দলের সদস্যদের সাথে বিরোধের কারণে এবং আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন সম্পর্কে স্পষ্টবাদী হওয়ায় পদ থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র ১ বছর।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী: প্রগতিশীল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১ বছরের মাথায় ইস্কান্দার মির্জার সাথে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগার: ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগার ১৭ অক্টোবর ১৯৫৭ সালে ষষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তার শাসনকাল মাত্র দুই মাস স্থায়ী হয়।

ফিরোজ খান নুন: ফিরোজ খান নুনকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে উন্নীত করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে ফিরোজ খানকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি এক বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

নুরুল আমিন: ১৩ বছর সামরিক আইনের পর নুরুল আমিন স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হন। দায়িত্বে থাকার ১৩ দিনের মধ্যে ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমিনকে প্যাকিং পাঠানো হয়েছিল।

জুলফিকার আলী ভুট্টো : জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৪ আগস্ট, ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ১৯৭৭ সালে আবার সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়লাভ করেন, কিন্তু সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল হক তাকে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৭৯ সালে ভুট্টোর ফাঁসি হয়।

মুহাম্মদ খান জুনেজো :  মুহাম্মদ খান জুনেজো সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে ২৩ মার্চ ১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। জুনজো সরকারকে ১৯৮৮সালের ২৯ মে বরখাস্ত করা হয়ে। তার শাসনকাল মাত্র তিন বছর স্থায়ী হয়।

বেনজির ভুট্টো: পাকিস্তানে জেনারেল জিয়া-উল-হকের বছরের পর বছর সামরিক শাসনের পর বেনজির ভুট্টো ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে তার দল অভিশংসন থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু, তার সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি এবং ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক খান তাকে সরিয়ে দেন। তিনি দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।

নওয়াজ শরীফ: নওয়াজ শরীফ ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু, ১৯৯৩ সালে আবারও রাষ্ট্রপতি গুলাম ইসহাক খান একটি নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করেন। পরে সুপ্রিম কোর্ট শরীফের সরকারকে পুনর্বহাল করেন। কিন্তু, সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান ওয়াহিদ কাকার ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই নওয়াজ শরীফ এবং গুলাম ইসহাক খানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তিনি তিন বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

বেনজির ভুট্টো: বেনজির ভুট্টো ১৯৯৩ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু, এবারও তিনি তার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। কারণ রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে তার সরকারকে বরখাস্ত করেন। তার শাসনকাল ৩ বছর স্থায়ী হয়।

নওয়াজ শরীফ: নওয়াজ শরীফ ১৯৯৭ সালের নির্বাচনের পর পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। তবে, তার পূর্বসূরির মতো তিনিও ৫ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। তিনি দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।

মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি:  জাফরুল্লাহ খান জামালি স্বৈরশাসক পারভেজ মোশারফের অধীনে প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু, মোশাররফ তাকে বরখাস্ত করার আগে তিনি মাত্র ১৯ মাস দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনকাল ১৯ মাস স্থায়ী হয়।

চৌধুরী সুজাত:  চৌধুরী সুজাত ২০০৪ সালের ৩০ জুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন। শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন সুজাত।  তিনি মাত্র ২ মাস দায়িত্ব পালন করেছেন।

শওকত আজিজ: শওকত আজিজ ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করেন। তার শাসনকাল ৩ বছর স্থায়ী হয়।

ইউসুফ রাজা গিলানি: ইউসুফ রাজা গিলানি ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৮তম প্রধানমন্ত্রী হন। তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করে। কিন্তু, ২০১২ সালে শীর্ষ আদালত অবমাননার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার শাসনকাল ৪ বছর স্থায়ী হয়।

রাজা পারভেজ আশরাফ: পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদ শেষ করতে গিলানির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজা পারভেজ আশরাফ। ২০১২ সালের ২২ জুন থেকে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি এক বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

নওয়াজ শরীফ:  নওয়াজ শরীফ ২০১৩ সালের জুনে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন। পাকিস্তানের পূর্ববর্তী সব প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় এখন পর্যন্ত তিনি সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক অভিশংসিত হওয়ার আগে তিনি ৪ বছর ৫৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি চার বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

শাহীদ খাকান আব্বাসি: নওয়াজ শরীফকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে শাহীদ খাকান আব্বাসিকে ২১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের আগস্টে তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু, ২০১৮ সালের ৩১ মে তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কারণ নতুন নির্বাচনের জন্য পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। তিনি ১ বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইমরান খান: ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইমরান খান। কিন্তু, ইমরান খানও নিজের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারান ইমরান খান। তিনি তিন বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com