জনগণের কল্যাণ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি

0

আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখীতে মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। দিনমজুর থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে দ্রব্যমূল্য। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেই। খোদ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছেন যে, দেশের জনগণের কল্যাণ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে ব্যয়ের চাপে পিষ্ট এখন খেটে খাওয়া মানুষের জীবন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্য বাড়ার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। জীবনধারণের জন্য অনেক মানুষ এখন অতি-দরকারি চাহিদার ন্যূনতমটুকুও মেটাতে পারছে না। বেশিরভাগ ভোক্তা এখন সস্তা পণ্য খুঁজছেন। প্রায় দুই কোটি মানুষের উচ্চ ব্যয়ের শহর ঢাকায় সীমিত আয়ের লোকজন জীবনধারণ করেন অনেক কষ্টে। দিন দিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ে না।

পণ্যমূল্য অতি বেশি, যানবাহনে চলাচল ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল ও বাসা ভাড়াসহ ব্যয়ের সাথে আয়ের ভারসাম্য নেই। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবনযাত্রার এই চাপ হতাশার সৃষ্টি করে। আর এই হতাশার কারণে অনেক নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। জীবন এবং জীবিকা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্তের সামনে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিকার সন্ধানে থাকা মানুষগুলো আজ অপ্রিয় অথচ কঠিন সত্যের মুখোমুখি। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবনের জীবিকা রক্ষাও এখন বড় ব্রত। ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঢুঁ দিলেই দেখা যাবে পরিপাটি বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট লেখা সাইনবোর্ড। পাড়ার মোড়ের দেয়ালগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ছেয়ে থাকে অথচ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে টু-লেট, সাবলেটের অগণিত বিজ্ঞাপন।

সাবলেট অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখানে কোনো ছোট পরিবারের এক রুমের বাসা ছিল। কিন্তু আয়-ব্যয়ের সমন্বয় না হওয়ায় তাদের সেই আশ্রয়ও কেড়ে নিয়েছে। নিদারুণ কষ্টের এসব কথাগুলো হয়তো বড়রা হজম করলেও বাড়ির ছোট ছেলেমেয়ে বা অন্যকে বলা যায় না। কর্মহীনতার কষ্ট, না খেয়ে দিনযাপনের কষ্ট, খিদের কষ্ট, স্কুলে না যাওয়ার কষ্ট কিংবা তাদের ছোট ছোট আবদার পূরণ করতে না পারার কষ্ট মধ্যবিত্ত সমাজের জানানোর জায়গা নেই।

এদিকে রাজধানীতে বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। নেই কোনো নীতিমালাও। যখন ইচ্ছে তখনই বাসাভাড়া বৃদ্ধি করে বাড়ির মালিকরা। সিন্ডিকেট করে খাদ্যদ্রব্য কিংবা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বাড়ে যখন তখন। আবার গণপরিবহনেও ভাড়া নিয়ে চলে নৈরাজ্য। বাসে উঠলেই সর্বনিম্ন ভাড়া গুনতে হয় ১০ টাকা। সব মিলিয়ে রাজধানীতে বাড়তি ব্যয়ের চাপে ত্রাহিদশা সীমিত আয়ের লাখ লাখ মানুষের।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, গত ২ বছর শ্রমিকের বেতন বাড়েনি। কিন্তু সকল সূচকেই বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। আর দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রা ব্যয়ের প্রভাব পড়েছে ১৬ কোটির অধিক মানুষের ওপর।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। আয় বৈষম্য দূর করাও জরুরি বলে মত তাদের।

ক্যাব জানায় গত চার বছরের মধ্যে ২০২১ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বর্তমানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ শতাংশে।

সংস্থাটির প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ২০২১ সালে যা আরো বেড়ে যায়। পূর্ববর্তী ২০১৯ সালে এ বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

২০২০ থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। গত এক বছরে আটা ও ময়দার মূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম গড়ে বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। শাক-সজির মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বাস্তব পরিস্থিতি এমন হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমিত আয়ের ভোক্তাদের সস্তা পণ্যের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। চালের ক্ষেত্রে, তারা আর ভালো মানের খোঁজ করে না।

স্বল্পপরিমাণে কিনছেন নন-ব্র্যান্ডের পণ্য। ঢাকার সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের একটি চালের দোকানের মালিক সাব্বির আহমেদ বলেন, তার অনেক গ্রাহক, যারা আগে ভালো চাল কিনতেন, তারা এখন মোটা চাল বেছে নিচ্ছেন। মিনিকেট ভ্যারাইটির দাম এখন প্রতি কেজি ৬৬-৬৮ টাকা, অন্যদিকে মোটা চাল ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান সাব্বির।

তিনি বলেন, আমার ভালোমানের চালের বিক্রি কয়েকদিন আগের দৈনিক ৮০-১০০ কেজি থেকে এখন ৫০ কেজিতে নেমে এসেছে। একই বাজারের সবজি বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম জানালেন, দাম বেশি হওয়ায় তার বিক্রিও কম হচ্ছে। বেগুন, কুমড়ো, করলা ও লেবুর মতো দামি সবজি কেনা থেকেও বিরত থাকছেন মানুষ। ভোক্তারা বেশিরভাগই আলু ও টমেটো কিনছেন, যা এখন সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। মধ্যবিত্ত মানুষ, যারা আগে অনেকে সুপারশপ থেকে কিনতেন, তারাও সস্তার বিকল্প খুঁজছেন।

মীনা বাজারের হেড অব অপারেশন শামীম আহমেদ জায়গিরদার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে স্কয়ার, ইউনিলিভারের মতো ব্র্যান্ডের প্রসাধনী বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। মাসওয়ারি হিসাবে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে বিক্রি ৮-১০ শতাংশ কমেছে। সবজির বিক্রিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এছাড়া মানুষ এখন সাবান, তেল ও শ্যাম্পুর ছোট প্যাকেট কিনছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন বলা হয়েছে-চলতি অর্থবছরের দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৫৯ শতাংশ। এই সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫.২১ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.১৯ শতাংশে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষের ঘরে দুই তিন দিনের বেশি আহার নেই। এই অবস্থায় বসবাস করছি। ৯০ ভাগ মানুষ দিন আনে দিন খায়। এটাই আমাদের ধারণা। যখন আয় কমে যায়, তখন নিম্ন আয়ের মানুষের প্রথম ক্ষতি হয় তাদের খাদ্য গ্রহণ। জীবনধারণের এই অতি-দরকারি চাহিদা মেটাতে, অনেকে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে কাজ করতে পাঠায়। অনেকে চিকিৎসায় খরচ বন্ধ করতেও বাধ্য হয়, যার ফলে ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। তাই নিম্ন আয়ের মানুষের জীবধারণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে

দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন-মানুষের আয় যদি জীবনযাত্রার ব্যয়ের চেয়ে বাড়ে, তাহলে সমস্যা নাই। যদি জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে আয় না বাড়ে, মানুষের কষ্ট হয়। তখন জীবনযাত্রার মানও কমে যায়। যাদের আয় বাড়ছে না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কখনই কাম্য নয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com