বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার বড় ছেলে ইশরাক হোসেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে মনোনয়নপত্র কেনা ও জমা দেওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রচারে সার্বক্ষণিক ছায়ার মতো পাশে রয়েছেন অবিভক্ত ঢাকার আরেক সাবেক মেয়র ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিভক্ত ঢাকার একাংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে তিনি বিএনপির মেয়র প্রার্থী হলেও এতটা সময় নির্বাচনী প্রচারে ব্যয় করেননি। মেয়র প্রার্থী ইশরাক বলেন, ‘আঙ্কেল সার্বক্ষণিক আমার সঙ্গে আছেন। প্রচার থেকে শুরু করে নির্বাচনী পরিকল্পনাসহ সব কাজেই সহযোগিতা করছেন তিনি। বাবা জীবিত থাকলে যেভাবে পাশে থাকতেন ঠিক তেমনিভাবে আব্বাস আঙ্কেল আছেন আমার পাশে। শক্তি, সাহস জোগাচ্ছেন, মনোবল বৃদ্ধি করছেন। আব্বাস আঙ্কেল আমাকে ঋণের জালে আবদ্ধ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘শুধু আব্বাস আঙ্কেলই নন, আফরোজা আব্বাস আন্টিও আছেন আমার সঙ্গে। প্রয়োজন পড়লে আমি নিজেও তাদের শাহজাহানপুরের বাসায় যাই। আর তারা সবসময় আমাদের বাসায় আসছেন। আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করছেন, কথা বলছেন। নির্বাচনী অফিসে মিটিং করছেন। এক কথায় একজন অভিভাবক হিসেবে যা যা করা দরকার তার সবই করছেন আব্বাস আঙ্কেল।’
মহানগর নেতারা জানিয়েছেন, এক সময়ে ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে খোকা-আব্বাস একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ঢাকার বিএনপির রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খোকা গ্রুপ-আব্বাস গ্রুপ মাঝেমধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, দুই নেতার দ্বন্দ্বে ঢাকায় বিএনপির রাজনীতি অনেকটা থমকে গিয়েছিল। দুই দফায় দ্ইু নেতাকে ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্ব দেওয়া হলেও দ্বন্দ্বের কারণে তারা ঢাকা মহানগর বিএনপির ওয়ার্ড ও থানা বিএনপির কমিটি সুষ্ঠুভাবে করতে পারেননি। শেষে মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও দলের বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করা হলে তারাও মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করতে পারেননি। পরে তাদের বাদ দিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এই দুই ভাগে কমিটি গঠন করে দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়ার পরও মহানগর কমিটি শক্তিশালী হয়নি আজও। প্রথমে মির্জা আব্বাস ঢাকার মেয়র ছিলেন। পরে খোকা ঢাকার মেয়র হন। খোকা প্রায় ১০ বছর ঢাকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুজনই অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। খোকা আমেরিকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেইসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আব্বাস। পরে খোকার মরদেহ ঢাকায় আনার পর থেকে তার লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক ছিলেন আব্বাস। খোকার মৃত্যুতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান হয়।
ইশরাকের নির্বাচনী প্রচারে ছায়ার মতো থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গতকাল বলেন, ‘আমার বন্ধু খোকা এখন আর ইহজগতে নেই। খোকার ছেলে আমার সন্তানের মতো। বলতে গেলে ইশরাকের অভিভাবক হিসেবে বর্তমানে আমি ভূমিকা রাখছি। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব তার সবটুকুই আমি করব। শুধু নির্বাচন নয়, আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন যেকোনো আপদ-বিপদে আমি ইশরাকের পাশে আছি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের অবিভক্ত সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন তার দীর্ঘদিনের রাজনীতির সহযোদ্ধা, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি লেখেন, ‘তুমি (খোকা) আর আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে কাজ করে যাব। না হয় সেই আগের মতোই স্বার্থপর কোনো মানুষদের জন্য আব্বাস আর খোকা বাইরে বাইরে দূরত্বের সেই অভিনয়টা করে যাবে, আর ভেতরে থাকবে দুজনের প্রতি দুজনের অন্তর নিংড়ানো ভালোবাসা। আল্লাহ তোমার সুস্থতা দান করুক। তুমি ফিরে এসো খোকা, তুমি ফিরে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব।’
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল বিভক্ত ঢাকার একাংশ ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন মির্জা আব্বাস। তখন তিনি নিজে নির্বাচনী প্রচার কমই চালিয়েছেন। তার পক্ষে তার স্ত্রী ও মহিলা দল কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আফরোজা আব্বাসই বেশি প্রচার চালিয়েছিলেন। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের শেষ মেয়র ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন খোকা। ২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন তিনি। গত বছর ১১ নভেম্বর নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন খোকা।
গত তিন দিন ইশরাকের প্রচারে দেখা গেছে মির্জা আব্বাসকে। যেখান থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন ইশরাক সেখানেই দেখা গেছে তাকে। গতকাল দুপুরে জর্জ কোর্টে মামলায় হাজিরা ছিল মির্জা আব্বাস, ইশরাকসহ আরও অনেকের। তারা প্রথমে জর্জ কোর্টে মামলায় হাজিরা দেন। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে জর্জ কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে তৃতীয় দিনের মতো প্রচার শুরু করেন ইশরাক। সেখানে তার পাশেই ছিলেন মির্জা আব্বাস। শুধু তিনি নন, তার স্ত্রী ও মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আফরোজা আব্বাসও ইশরাকের সঙ্গে ছিলেন।
শুধু মির্জা আব্বাস একাই নন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আবদুস সালাম, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সসহ আরও অনেকে ইশরাকের প্রচারে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন।