উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা।
উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এ ছাড়া ওই সপ্তাহে শুধুমাত্র ঢাকাতেই
তিন শিশু, দুই তরুণী ও দুই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একটি মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে বিদায়ী বছরেই সারা দেশে ১৪১৩ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এটি বিগত দিনের সর্বোচ্চ রেকর্ড। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এছাড়া নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে মামলার গুরুত্ব দেয়া আর সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনভাবে কাজের জন্য এ ধরণের ঘটনা বাড়ছে।
আর বরাবরের মত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ধর্ষণ নয় সব ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা। যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন অপরাধীকে ধরে তারা শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৯ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৩৭৪টি। এরমধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৮৬টি, গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৮টি ও ধর্ষণের উল্লেখ নেই এমন ঘটনা ঘটেছে আরও ১১০টি। সংস্থাটির তথ্যমতে ২০১৫ সালে সারা দেশে ৪৮৪টি একক ধর্ষণ, ২৪৫টি গণধর্ষণ ও ধরণ উল্লেখ নেই এমন আরও ২৩টি ধর্ষণ নিয়ে ওই বছরে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৫২টি। একইভাবে ২০১৬ সালে ৪৪৪টি একক ধর্ষণ, ১৯৭টি গণধর্ষণ ও ধরণ উল্লেখ নাই এমন আরও ১৮টি ধর্ষণ নিয়ে মোট ৬৫৯ টি ধর্ষণকাণ্ড ঘটেছে। ২০১৭ সালে সারা দেশে ৮১৮টি ধর্ষণকাণ্ড হয়েছে। এরমধ্যে ৫৯০টি একক ধর্ষণ, ২০৬টি গণধর্ষণ ও ধরণ জানা যায়নি এমন ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে মোট ৭৩২টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে একক ধর্ষণ হয়েছে ৫০২টি, গণধর্ষণ হয়েছে ২০৩টি আর অজানা ধরণের আরও ২৭টি। আসকের পরিসংখ্যান মতে গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটেছে। ওই বছর সারা দেশে ১৪১৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে শুধু একক ধর্ষণ হয়েছে ১ হাজার ৬৬টি, গণধর্ষণ ৩২৭টি ও ধরণ সম্পর্কে জানতে পারে নাই এমন আরও ২০টি ঘটনা রয়েছে।
আসকের তথ্য মতে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪৬ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৪৮জন। এরমধ্যে ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। ২০১৬ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন। ২০১৭ সালে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন আর আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ২০১৯ সালে ৭৬ জনকে হত্যা আর আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন।
এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী গত আট বছরে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ৭৮টি। এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬২৬ জনকে। ২০১৯ সালেই সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ১ হাজার ৬০৭টি। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে। পুলিশ সদরদপ্তরের গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলা বিশ্লেষন করে দেখা গেছে এই আইনে করা মোট মামলার ৫১ দশমিক ৬০ শতাংশই ধর্ষণ মামলা। আর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মামলার ৫২ দশমিক ১০ শতাংশই ধর্ষণ মামলা। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলায় সাজার হারও কম। পরিসংখ্যান বলছে মাত্র ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতার একটি সময় চলছে আর সেটি ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে নারী নির্যাতন নীপিড়ন দ্বিগুন হয়েছে। চলতি বছরে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। সামাজিক অস্থিরতার মূল কারণ হলো, অন্যান্য মামলাগুলোর মত সমান গুরুত্ব পায় না। সামাজিক ঐতিহ্য বা সামাজিক শিষ্ঠাচার তৈরি করতে গেলে রাষ্ট্র বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সম্পর্ক, ব্যক্তিত্ব ও অবস্থানকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বিচারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় প্রশাসন এটিকে যত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে তার কয়েকদিন পরে একটি বাসে এক নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়টি এত বেশি আলোচিত হয়নি। কারণ যে ধর্ষণের শিকার হয় তার সামাজিক মর্যাদা অনুসারে তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের নারীকে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে মূল্যায়ন করা হয়। আমরা সমানতালে সব নারীকে মূল্যায়ন করতে পারছি না। আর না পারার কারণেই ধর্ষকরা এই সংকটের সুযোগটা নিচ্ছে। এছাড়া আমাদের বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি রয়েছে। যে ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয় সেটির বিচার খুব দ্রত হতে দেখি। না হলে এক ঘটনার পেছনে অন্যটি হারিয়ে যায়। তাই এখানে বিচারহনীতার পাশপাশি প্রত্যেকটি ঘটনাকে সমানভাবে গুরুত্ব না দেয়ার বিষয় রয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষক নেহাল করিম বলেন, ছোট বাচ্চাদের ধর্ষণ যারা করে তাদের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাব রয়েছে। এরা বিকৃত রুচির মানুষ। সমাজে যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা থাকত তবে এ ধরণের ঘটনা ঘটতো না। স্কুল কলেজের ছাত্রীদের বখাটেরা নোংরাভাবে টিজ করে। যারা এসব করে তারা কখনওই মেয়েদের সংস্পর্শে আসে নাই। তাদের মধ্যে নারীদের প্রতি সম্মান দেখানোর নিম্নতম শিক্ষাটুকু নাই। তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার পেছনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা কাজ করছে। এছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠেনি। কোনো দেশের সরকারই ধর্ষণের মত ঘটনা কমাতে পারবে না। সমাজে যারা আমরা আছি তারাই এগুলো প্রতিহত ও সচেতনতা বৃদ্ধি করলে এগুলো কমে যাবে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনজীবী, সমাজতথ্যবিদরা একসঙ্গে বসা উচিত। সবাই একসঙ্গে বসলে তারা একটি ব্যাখ্যা দিবেন ধর্ষণের ঘটনা কেন হচ্ছে বা কেন বাড়ছে। সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। একেকজন একেকরকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আমাদের নারী সমাজ বাহিরে কাজ কর্ম করে এজন্য ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। নাকি আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে ও আইনের দীর্ঘসুত্রিতারও বিষয় আছে। মামলা হলে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে। সেটি নিষ্পত্তি হতে অনেক লম্বা সময় লাগে। এই বিষয়গুলো দেখার বিষয় আছে। এছাড়া মামলা তদন্তের পর যখন কোর্টে যাবে তখন তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসক ডেকে পাওয়া যায় না। সাক্ষীদের ম্যানেজ করে উপস্থিত করা যায় না। তিনি বলেন, সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বলে। দেশে অপরাধ প্রবণতা থাকবেই কিন্তু কেউ যদি মনে করে অপরাধ করলে পার পেয়ে যাবে এমন চিন্তা আসাটা ঠিক না। আমাদের নৈতিকতার জায়গায় চিন্তা করতে হবে।