আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরও ভয়াবহভাবে ‘গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা’
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা কমে গেছে মনে হলেও আত্মতৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। নিষেধাজ্ঞা কিছুটা কমে গেলে এবং আগামী ’২৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরও ভয়াবহভাবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বাড়তে পারে।
গতকাল সোমবার ‘কোথায় সেই সব মানুষ? বাংলাদেশে গুমের ঘটনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বক্তারা। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এ ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সির্টির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইসড অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ। তিনি সিজিএস’র উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও এই কার্যক্রমের মুখ্য গবেষক।
সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নূর খান প্রমুখ। গবেষণাটিতে সহকারী হিসাবে ছিলেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর গবেষক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, দীপাঞ্জলি রায়, সুমাইয়া জাহিদ এবং আরমান মিয়া।
মূল প্রবন্ধে ড. আলী রিয়াজ বলেন, পাঁচ সদস্যের গবেষক দল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ৭১টি গুমের ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেন। এসব ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা প্রকৃতপক্ষেই গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ১১ জন ব্যবসায়ী, আটজন ছাত্র, পাঁচজন ইসলামিক বক্তা বা মসজিদের ইমাম এবং তিনজন সাংবাদিক রয়েছেন। ৭১ জনের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেছে। ১৬ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ২৩ জন ফিরে এসেছেন। ২২ জনকে পরবর্তীকালে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এসব গুমের ঘটনার মধ্যে ৫২টির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি অর্থাৎ ৪০ দশমিক ৩৮ ভাগ ঘটনায় র্যাব, ১৬টি ঘটনায় অর্থাৎ ৩০ দশমিক ৭৬ ভাগ ঘটনায় ডিবি পুলিশ এবং ১১ দশমিক ৫৩ ভাগ ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, গুমকে কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে চলবে না, প্রত্যেকটি গুমের ঘটনা একেকটি পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। পর্যবেক্ষণ অনুসারে, পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং পথচারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত কথিত গুমের ঘটনার বেশিরভাগ বিবরণ একই রকম।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিযোগ করছে যে, বাংলাদেশে বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বছরের পর বছর ধরে গুমের ঘটনাকে অস্বীকার করে আসছে। গুম নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সংগঠনটি বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করেছে। বর্তমানে এ সংগঠনটি হুমকির সম্মুখীন। গবেষণাপত্রে ড. আলী রীয়াজ সুপারিশ করে বলেন, প্রত্যেকটি গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকার ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের সদস্য এবং সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করতে হবে। জাতিসংঘের কমিটি যেসব নিখোঁজ ব্যক্তির ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে সেগুলো অবিলম্বে প্রদান করতে হবে এবং ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরের অনুমতি দিতে হবে। ভুক্তভোগীদের পরিবারের যে কোনো ধরনের হয়রানি বন্ধ করা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি সহায়তাসহ অন্যান্য সহযোগিতা নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ওয়েবিনারে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে গুমগুলোর বেশিরভাগই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাদের কয়েকজন ফিরে এলেও তারা ভয়ে কোনো কথা বলেন না। গুমের মাধ্যমে দেশে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। গত নির্বাচনে যারা দায়িত্বে ছিলেন গুম হওয়ার ভয়ে অনিয়ম দেখেও তারা কোনো বাধা দিতে পারেননি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কমে গেলেও আগামী নির্বাচনের আগে আবারও গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বাড়তে পারে।
ড. বদিউল আলম বলেন, অনেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন। তারা নিজস্ব বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভাড়া করে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে যারা গুম করছেন পরিস্থিতি বদলে গেলে তারাও একদিন এ ধরনের ঘটনার শিকার হতে পারেন। এজন্য তাদের উচিত এখনই সংযত হওয়া। একই সঙ্গে দেশের সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে একতরফা নির্বাচনকে টিকিয়ে রাখার জন্যই দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, সুশাসনের অভাব দেশে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর গুম কমেছে। এই পরিণাম আরও ভয়াবহ। কেননা সরকার জনগণের কথা চিন্তা করেনি। বরং সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যক্তিগত ক্ষতির আশঙ্কা থেকে গুমের ঘটনাকে কমিয়ে দিয়েছে। তিনি আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো ভূরাজনৈতিক কারণে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, তবে আসন্ন নির্বাচনের আগে দেশে আবার গুমের মতো ঘটনা ঘটবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের কারা ধরে নিয়ে যায়, তা এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষই জানে। বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় দেখা গেছে প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই একই রকম বিবৃতি। তিনি বলেন, মূলত রাজনৈতিক কারণে বিরোধী মত দমন করতে এবং এক ধরনের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মানুষ এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে থাকছে, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনিসংকেত।
তিনি বলেন, গুমের মাধ্যমে মানুষের বিরুদ্ধে মতকে দমন করে সরকার নির্বাচনকে অস্বীকার করে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে। সরকার নিজেদের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নগ্নভাবে ব্যবহার করছে। ফলে জনগণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। রক্ষক হয়ে উঠছে ভক্ষক। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী যেখানে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, সেখানে জনগণকে অসহায় করে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আশা করা যায় না।
নূর খান বলেন, গবেষণায় সরকারের তৃতীয় মেয়াদের ঘটনা উঠে এসেছে। যখন সরকার কোনো বাধার মুখে নেই। তাহলে এর আগে আরও কত বেশি গুম হয়েছে তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, যারা ফিরে এসেছেন তারা কোনো কথা বলেন না। দু-একজন যারা কথা বলেছেন, তাদের এমন একটি জায়গায় রাখা হয়েছিল সেখানে বিমান ও ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। তাদের সেখানে একটি গোপন কারাগারে রাখা হয়েছিল। নূর খান বলেন, শুধু সাদা পোশাকেই, র্যাবের পোশাক পরেও গুমের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজসহ যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ঘটনার পর তা অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট বাহিনী। তিনি বলেন, গুম হওয়ার পর ভুক্তভোগী পরিবার থানায় গেলে পুলিশও মামলা নিতে চায় না। তারাও নানারকম ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে।